,

পইলের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা শুরু

জুয়েল চৌধুরী ॥ সবাই এ মেলাকে বলে মাছের মেলা। না মূলত এটা জামাই মেলা। বলছি, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল গ্রামের মাছের মেলার কথা। এ দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন সদর উপজেলার পইল ইউনিয়নবাসী। এক টিকেটে দুই ছবি! এ মেলায় আছে একের ভেতর দুই। এককথায় রথ দেখা আর কলা বেচা। কারণ এটা জামাই মেলা হলেও গত কয়েক দশক ধরে এখানে বসে মাছের বিরাট মেলা। পইল এবং এর আশপাশে গ্রামে যাঁরা বিয়ে করেছেন সেই জামাইরা হচ্ছেন ওই মেলার মূল ক্রেতা ও দর্শনার্থী। তা ছাড়া এ মেলাকে ঘিরে এলাকার জামাইদের মধ্যে চলে এক ধরনের নীরব প্রতিযোগিতা। আর এ প্রতিযোগিতাটি হচ্ছে কোন জামাই সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এ মেলা এখন মাছের মেলায় নাম ধারণ করেছে। শনিবার বিকাল থেকে শুরু হয়েছে পইল ইউনিয়নে জামাই মেলা খ্যাত মাছের মেলা। চলবে রবিবার দুপুর পর্যন্ত। বিকেলে সরেজমিনে পরিদর্শণ কালে দেখা যায়, একটা মাছকে ঘিরে ক্রেতা জামাইদের জটলা লেগে আছে। মাছের নাম বাঘাইড়। বিক্রেতা দাম হেঁকেছেন ৪০ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় এক জামাই মাছটির দাম সর্বোচ্চ ১১ হাজার টাকা বলছেন। কিন্তু বিক্রেতা আরো বেশি দাম পাওয়ার আশায় মাছটি ছাড়ছেন না। চলছে দরকষাকষি। যত না ক্রেতা, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক জনতা ভিড় জমিয়েছেন মাছটি দেখার জন্য। পৌষ মাসের শেষে মাঘ মাসের প্রথম দিন শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে পইল গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় গিয়ে দেখা যায় এই দৃশ্য। পইল ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন তো এসেছেনই। এর বাইরে থেকেও অনেকে এসেছেন উপজেলার সর্ববৃহৎ এই মাছের মেলায়। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার উমেদ নগর গ্রামের শুকুর মিয়া মাছের দোকানে গিয়ে দেখা যায় প্রচুর ভিড়। মেলায় সবচেয়ে বড় মাছটি তুলেছেন তিনি। ১০ কেজি ওজনের বাঘাই মাছটির দাম চাওয়া হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। সবার দৃষ্টি এ মাছটির প্রতিই। কেউ বলছেন ৯ হাজার আবার কেউ বলছেন ১০ হাজার। কেউ আবার কারো কারো সাথে শলা পরামর্শ করছেন। ভাবখানা এমন যেন তারা কোরবানির গরু কিনতে এসেছেন। হবেই না-বা কেন। মাছের দাম কি আর কুরবানির গরুর দামে চেয়ে কম। মেলা আয়োজক কমিটি জানান, ব্রিটিশ শাসনামলে শুরু হওয়া মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত। এলাকার জামাইরা বলেন, শ্বশুরবাড়িতে মাছ নিয়ে যাওয়া বলে কথা। তাই এলাকার জামাইদের নজর পইল গ্রামের মাছের মেলার বড় মাছটার দিকেই। তাই স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহখানেক ধরে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন। সেই অনুযায়ী মাছের দামও হাঁকানো হয়। মেলা নিয়ে কথা হয় নাজিরপুর গ্রামের জামাই সোহেল মিয়ার সাথে। তিনি জানান, এবার সাড়ে ১৫ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পশ্চিম পাড়া গ্রামের জামাই ফজল মিয়া বলেন, ‘মাছের মেলাটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের ধারক। মেলায় বেচাকেনা যতই হোক, এ মেলা আমাদের ঐতিহ্য আর কৃষ্টি-কালচারকে বহন করছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা।’ লামা পইল গ্রামের আরেক জামাই সালাহ উদ্দিন জানান, শুরুতে এ মেলা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য হলেও, বর্তমানে এটা সব ধর্মের মানুষের কাছে ঐতিহ্যের উৎসবে পরিণত হয়েছে। বড় বড় রুই, বোয়াল, চিতল, আইড়, বাগাইড়সহ বিভিন্ন জাতের মাছ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ মাছ কিনছেন। কেউ দেখছেন। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মেলায় হবিগঞ্জের ভাটি উপজেলা বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, লাখাই ছাড়াও মৌলভীবাজারের শেরপুর ও কিশোরগঞ্জের ভৈরবসহ দেশের নানা স্থান থেকে মৎস্যজীবীরা মাছ নিয়ে আসেন। মাছ ছাড়াও এই মেলায় শীতের শাকসবজি, গরম কাপড়, কৃষিপণ্য, কাঠের আসবাব ও বিভিন্ন খাবারের দোকান ছিল।


     এই বিভাগের আরো খবর