,

চলে গেলেন জনতার নায়ক ॥ হাওরই হলো শেষ ঠিকানা

আনোয়ার হোসেন মিঠু/রিপন দেব ॥ না ফেরার দেশে চলে গেলেন জনতার নায়ক, ভাটি-বাংলার সিংহপুরুষ, সংসদ কাঁপানো বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। গতকাল রবিবার ভোরে ৪টা ২৪ মিনিটে তিনি রাজধানী ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি রক্তে হিমোগ্লোবিন স্বল্পতাজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। আজ সোমবার তার মরদেহ সকালে হেলিকপ্টারে করে সিলেট, সুনামগঞ্জে নেয়া হবে। সেখানে তিন দফা শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকালে দিরাইয়ে তার গ্রামের বাড়িতে শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে। গত শুক্রবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ল্যাবএইডে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে শনিবার রাত ৮টার দিকে তাকে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। গত বছরের মে মাসে শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পরে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালেও চিকিৎসা নেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলা জুড়ে। তার ভক্ত-অনুরক্তরা শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। গতকাল ভোর থেকে সুরঞ্জিত সেনের দিরাই উপজেলা সদরের বাসভবনে ভিড় করতে থাকেন দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সর্বশেষ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দিরাই এসেছিলেন হেলিকপ্টারে চড়ে। আবারও তিনি হেলিকপ্টারে করে আসলেন। তবে আর ফিরে যাওয়া হবে না তাঁর। চিরদিনের জন্য মিশে যাবেন ভাটিবাংলার মাটি ও জলে। ভাটি-বাংলার সিংহপুরুষ খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের জন্য ইতিহাস গড়ে দিয়ে ৭২ বছরের পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্তি শেষে চিরনিদ্রার জন্য ফিরে আসছেন দিরাই উপজেলার প্রিয় আনোয়ারপুর গ্রামে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ই মে, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে। চিকিৎসক দেবেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মা সুমতিবালা সেনগুপ্তের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট সুরঞ্জিত সেন। দিরাই মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাঠশালার পাঠ শেষে স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন। কিছু দিন আইন পেশায়ও নিয়োজিত ছিলেন তিনি। তবে সে পরিচয় এক সময় আড়াল হয়ে যায় তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের কাছে। হাওরের খোলা হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শৈশবে হতে চেয়েছিলেন যাত্রাপালার নায়ক। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গিয়েছিলো। তিনি নায়ক হয়েছিলেন ঠিকই, তবে যাত্রাপালার নয় নায়ক হয়েছিলেন জনতার। তিনি হয়ে উঠেছিলেন মাটির নায়ক, রাজনীতির নায়ক। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অনেক ঘটনাতেই নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধান তৈরিতেও তার অবদান অসামান্য। টানটান উত্তেজনা, নাটকীয়তা তার রাজনৈতিক জীবনেরই অংশ হয়ে গিয়েছিলো। একদম অল্প বয়সেই রাজনীতির মঞ্চে নায়ক হিসেবে তার আবির্ভাব। বাম রাজনীতির চারণভূমি সুনামগঞ্জ থেকে উঠে আসা সুরঞ্জিতের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিলো বাম আদর্শের সৈনিক হিসেবে। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের নির্বাচনে ন্যাপ থেকে জয়ী হয়ে নজর কাড়েন দেশবাসীর। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের সাব-কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন সুরঞ্জিত। ১৯৭৩ সালে একতা পার্টি ও ১৯৭৯ সালে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রথম নির্বাচনেই ১৯৯৬ সালে হেরে যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পরে অবশ্য তিনি হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীঞ্জ) আসন থেকে উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। এরপর ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে চারবার আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জনতার প্রতিনিধি হয়ে সংসদেই ছিলেন। তার মৃত্যুতে কাঁদছে গোটা সিলেট বিভাগের মানুষ।


     এই বিভাগের আরো খবর