,

হবিগঞ্জ সদরের ওসি ইয়াছিনুল হকের সহযোগীতায় শিকলবন্দি জীবন থেকে উদ্ধার হাসপাতালে বহুলার আঃ মজিদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ শহরতলীর বহুলা গ্রামের পয়ত্রিশোর্ধ আব্দুল মজিদকে শিকলবন্দি থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সদর থানার ওসি মোঃ ইয়াছিনুল ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। মজিদ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের কেবিনে ভর্তি রয়েছে। উদ্ধারকালে ওসির সাথে ছিলেন ওসি (অপারেশন) ডালিম আহমেদসহ একদল পুলিশ। এর আগে ওসি ইয়াছিনুল হক স্বপ্রণোদিত হয়ে শিকলবন্দি আব্দুল মজিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য একটি ফান্ড গঠন করেন। এখানে বিভিন্ন লোকজন আর্থিক সহায়তা করেছেন। ওসি জানান, ওই ফান্ডে ১ লাখ টাকা জমা হয়েছে। এ টাকা দিয়ে মজিদের
ঘর তৈরি করে দেয়া হবে। যার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সদস্যরা হলেন হেলাল আহমেদ, কুদরত আলী ও লাল মিয়া এ বিষয়ে তদারকি করবেন। এদিকে ওসি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুইটি শার্ট, ২টি লুঙ্গি, গেঞ্জি, জুতা, লেপ-তোষক ও পালংকসহ বিভিন্ন সামগ্রী মজিদকে উপহার দেন। রাত ১০টায় হাসপাতালে গিয়ে মজিদকে উন্নত মানের খাবার দেন এবং চিকিৎসার খবরাখবর নেন। অপরদিকে মজিদের বাড়িতে মাহিদা আক্তার (২৮) নামের মজিদের ছোট বোনকেও একই অবস্থায় পাওয়া যায়। মজিদকে উদ্ধার করার সময় মাহিদার সন্ধান পাওয়া যায়। ওসি আদালতের নির্দেশমতে আগামী রবিবার তাকে উদ্ধার করে তারও পুনবার্সনের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। সদর থানার ওসির এমন কর্মকান্ড দেখে শহরবাসি তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। উল্লেখ্য হবিগঞ্জ শহরতলীর বহুলা গ্রামের মৃত আব্দুর রশিদের পুত্র পয়ত্রিশোর্ধ আব্দুল মজিদ। অভাবের তাড়নায় আব্দুল মজিদ প্রায় ৪ বছর আগে পরিবারের লোকজনের সাথে রূঢ় আচরণ করতেন। শরীর স্বাস্থ্য ভাল না থাকায় কাজ করতে পারতেন না। তাই তিনবেলা খাবার জোগাড় করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এতে সংসারে মজিদকে নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি লেগেই থাকতো। বিয়ে করেছেন বাহুবল উপজেলার উত্তরসুর গ্রামে। দুই সন্তানের জনক আব্দুল মজিদ। সাংসারিক বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সাথে প্রায়ই খারাপ আচরণ করতেন। এ সুযোগে সুচতুর বড় ভাই আব্দুল হামিদ তাকে পাগল সাজানোর ফন্দি আঁটে এবং সফলও হয়। একদিন সন্ধ্যাবেলা মজিদ খাবার খেতে বসলে হামিদ ও ছোট ভাই আব্দুল মোতালিব তাকে জোরপূর্বক বেঁধে ফেলে। এরপর শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। তারপর এলাকায় প্রচার করতে থাকে মজিদ পাগল হয়ে গেছে। সেই থেকে অদ্যাবদি শিকলবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন আব্দুল মজিদ। শিকলবন্দি আব্দুল মজিদ জানান, তার বড় ভাই আব্দুল হামিদ সম্পত্তির লোভে তাকে হাত-পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে পাগল সাব্যস্থ করতে চাইছে। দুই বছর আগে প্রতিরাতেই তাকে মারধোর করতো। সপ্তাহে একদিন শুধু রাতে তাকে খাবার দেয়া হতো। উদ্দেশ্য ছিল তাকে খাবার না দিয়ে মেরে ফেলা। গ্রামের কোন লোক খোঁজ নিতে এলে বাড়ির লোকজন বলতো মজিদ পাগল হয়ে গেছে। তাই তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। লোকজনও বিশ্বাস করতো। কারণ, তার বড় ভাই মোশাহিদ ছিলেন পাগল। তার মতো মোশাহিদকেও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। খাবার চাইলে তার উপর চালানো হতো নির্যাতন। খাবার না পেয়ে মোশাহিদ মারা যায়। একদিন অন্ধকার ঘর থেকে মোশাহিদের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। মজিদ আরও জানান, তার স্ত্রীর জমানো ৬০-৭০ হাজার টাকা ছিল। তাকে চিকিৎসা করানোর কথা বলে আব্দুল হামিদ সেই টাকা আত্মসাত করে। আজ পর্যন্ত তাকে কোন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়নি। উপরন্ত তার স্ত্রী-সন্তানকে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মজিদ জানান, সম্প্রতি আব্দুল হামিদ চিকিৎসা এবং শিকলমুক্ত করার আশ্বাসে তার এক কেদার জমি বিক্রি করে। ওই জমি বিক্রির টাকা দিয়ে চিকিৎসাতো দূরের কথা বরং জিজ্ঞাসা করায় তার উপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। আত্মসাত করা হয় জমি বিক্রির পুরো টাকা। এ ব্যাপারে আব্দুল মজিদের স্ত্রী হালেমা খাতুন জানান, সম্পত্তির লোভে ভাসুর আব্দুল হামিদ তার স্বামীকে শিকলবন্দি করে পাগল সাজিয়েছে। খাবার না দিয়ে রাতদিন মারধোর করছে। সন্তানসহ তাকে বাড়ি থেকে মারধোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। দুই সন্তানকে নিয়ে এখন তিনি পিত্রালয়ে অবস্থান করছেন। হালেমা খাতুনের দাবি, চিকিৎসা দিলে তার স্বামী ভাল হয়ে যাবে। হালেমা খাতুন জানান, আইনের আশ্রয় থেকে বিরত থাকতে তাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে তার ভাসুর আব্দুল হামিদ। শুধু তাই নয়, আইনের আশ্রয় নিলে তার দুই সন্তানের ক্ষতি হবে বলেও প্রতিনিয়ত শাসিয়ে যাচ্ছে ভাসুর। এ অবস্থায় আব্দুল হামিদের নির্যাতন সেল থেকে স্বামীকে মুক্ত করতে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছেন হতভাগী হালেমা খাতুন। প্রতিবেশী নূরুজ্জামান চৌধুরী জানান, আব্দুল মজিদের কথা বার্তায় মনে হয় না সে পাগল। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন তাকে শিখলমুক্ত করতে। কিন্তু মজিদের পরিবারের লোকজন তাকে মুক্ত করতে নারাজ। তারা মজিদকে অহেতুক পাগল বলে প্রচার করছেন। তিনি জানান, তাকে শিকলমুক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে সে ভাল হয়ে যাবে। যেভাবে মজিদকে শিকলবন্দি করে রাখা হয়েছিল তা মানবাধিকার লংঘনের সামিল। তাকে শিকলমুক্ত করতে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছেন তিনি। প্রতিবেশী হাবিবুর রহমান, আবু তাহের সুমন, নাজমুল হোসেন, নূরুল আমীনসহ অনেকেই জানান আব্দুল মজিদ পাগল নয়। শুধু শুধু তাকে পরিবারের লোকজন শিকলবন্দি করে রাখে।


     এই বিভাগের আরো খবর