,

ইউ.এইচ.এফ.পি.ও ডাঃ জাহাঙ্গীর আলমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বেঁচে গেল নবীগঞ্জের এক গরীব অসহায় নারী ভানু রানী বিশ^াস [শাশুড়ীর মন্তব্য ছেলের বউ মারা গেলে ছেলেকে আবার বিয়ে করিয়ে নতুন বউ ঘরে তুলব!]

॥ আনোয়ার হোসেন মিঠু ॥
নবীগঞ্জ উপজেলার পানিউমদা ইউনিয়নের রইছগঞ্জ বাজারের পার্শ্ববর্তী খাগাউড়া গ্রামের দিন মজুর অর্জুন বিশ^াস (৩৮) ও তার স্ত্রী ভানু রানী বিশ^াস (২২)। এই ভুমিহীন গরীব দম্পতি তাদের প্রথম সন্তানের  মুখ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। স্বামী মাছ ধরে বিক্রি করে যেদিন বাজার সদাই নিয়ে আসে সেদিন উনুনে হাড়ি চড়ে নতুবা উপোস থাকতে হয়। দূর্গা পূঁজা চলছিল, সবাই আনন্দ করছে, হঠাৎ প্রসব ব্যাথা উঠতেই স্বামী অর্জুন বিশ্বাস গ্রামের দাই মাসীকে নিয়ে আসে। মাসী আশ্বাস দেন সবঠিক আছে। একদিন চলে যায়। দ্বিতীয় দিন হয়ে গেল, পানি ভেঙে গেল কিন্তু দাই মাসী আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন, আর বলছেন আমি এ রকম কত ডেলিভারী করেছি, একটু অপেক্ষা করো। পাশের বাড়ির একজন খবর দিলেন উপজেলার পানিউমদা ইউনিয়নের রইছগঞ্জ কমিউনিটি ক্লিনিকে নিরাপদ ডেলিভারী করানো হয়। কোন খরচ লাগেনা। সমস্যা হলে সরকারী ভাবে সবকিছু করা হয়। এ আশ্বাসে কিছুটা মনে সন্দেহ নিয়ে স্বামী অর্জুন  সিএসবি  শিপ্রা রায়কে ফোন করে সিসি তে নিয়ে আসলো ভানু রানীকে। শিপ্রা রায় জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারেন, কোন এএনসি সেবা নেয়নি এ গর্ভবতী। শ্রিপ্রা রায় ডা: ফয়সাল আহমদ কে ফোন করে বিষয়টি জানিয়ে ডেলিভারী ভালো ভাবে করে একটি চাঁদের মতো ফুটফুটে ছেলে সন্তান অর্জুনের বৃদ্ধা মায়ের হাতে তুলে দেন। ডেলিভারীর তৃতীয় ধাপে এসে বিপদ হয়ে গেল। গর্ভফুল বের হয়ে আসছেনা। জোরে টান দিতেই কর্ড ছিড়ে চলে আসলো। গর্ভফুল ভিতরে রয়ে গেল। শুরু হলো প্রাণঘাতি রক্তক্ষরণ। এভাবে কিছু সময় চেষ্টা করে ইউ এইচ এফ পি ও ডাঃ জাহাঙ্গীর আলমকে ফোন করলে তিনি ওই রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেরণ করার নির্দেশ দেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসার প্রায় ২ ঘন্টা পরে  রোগী  হাসপাতালে পৌঁছানোর সাথে সাথে ডেলিভারী রুমে নিয়ে পরীক্ষা করে প্রেসার পাওয়া যায় ৭০/৫০ মি মি পারদ। রোগীর  রক্তক্ষরণ হচ্ছে দ্রুত।  দুই হাতে দু’টো স্যালাইন দিয়ে রোগী রক্তের গ্রুফ জানার জন্য রক্ত নিয়ে ডিজিটাল ল্যাবে পাঠানো হলো। স্বামীর কাছে টাকা নেই জেনে ল্যাব মালিক  ফ্রি রক্তের গ্রুপ করে দিলেন। রোগীর  গ্রুপ ও পজেটিভ। পূঁজার ছুটি চলছে। এম টি ল্যাব বেনু ভূষন দাস ছুটিতে আছেন। রক্তক্ষরণ বেড়ে চলছে। মায়ের জীবন বাঁচাতে দ্রুত রক্ত দিতে হবে। অন্যথায় খারাপ কিছু হয়ে যাবে। ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার মান্নান কে দ্রুত এ্যাম্বুলেন্স বের করার নির্দেশ দিয়ে রক্তের ডোনার খোঁজার কাজে লেগে গেলেন। একেতো মফস্বল শহর আবার রাত। অনেকেই অপারগতা জানিয়ে ফোন কেটে দেন। রোগী নিয়ে হাসপাতালে আগত এক ড্রাইভার এগিয়ে এসে বলেন, স্যার আমার রক্তের  গ্রুপ জানিনা। আমি রক্ত দিতে রাজি আছি। ডা: জাহাঙ্গীর আলম বললেন,আপনার   গ্রুপ মিলে গেলে আপনার কাছ থেকেই রক্ত নেয়া হবে।  রোগীর আরো রক্ত দরকার। ইতিমধ্যে এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাজির। হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ রথীন্দ্র চন্দ্র দেব এর সহযোগীতা চেয়ে পূর্বেই অবহিত করে রেখেছেন ইউ এইচ ্ এফ পিও ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম। ফয়সাল আহমেদ কে ফোনে সব কিছু জানিয়ে অবগত করে প্রায় চার ব্যাগ ও পজেটিভ রক্তের ডোনার রেডি করে সদর হাসপাতালে যাওয়ার অনুরোধ করেন। সাথে সাথে ফয়সাল আহমেদ  জানালেন, উনার নিজের ও তার ছেলের রক্তের গ্রুপ ও পজেটিভ। এই দুই ব্যাগ রক্ত ও পাওয়া গেলো। সদর হাসপাতালে নাইট ডিউটি থাকার ফলে ডাঃ এস এম মেহেদী হাসান রোগীকে  সাথে করে নিয়ে ভর্তি করেন। সিনিয়র স্টাফ নার্সকে দেখিয়ে গাইনি কনসালটেন্টকে কল করেন।  সিনিয়র এম টি ল্যাব তুহিন রক্তের   গ্রুপ ও ক্রস ম্যাচিং করার জন্য দ্রুত আসার অনুরোধ জানান। ভাগ্য ভালো রোগী ভানু রানীর রক্তের গ্রুপের সাথে  স্বামীর অর্জুনের  রক্তের   গ্রুপ মিলে যাওয়াতে একব্যাগ রক্ত দ্রুত পাওয়ার আশার আলো দেখলেন চিকিৎসকরা। কিন্ত সেই আশা মুহুর্তের মধ্যেই মিলিয়ে গেলো রোগী ভানু রানীর শাশুড়ি চান না তার ছেলে বউয়ের জীবন বাঁচানোর জন্য রক্ত দিক। কারন রক্ত দিলে ছেলে দূর্বল হয়ে যাবে। কাজ করে খেতে পারবেনা। ছেলে অর্জুন হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাহিরে চলে গেলো। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচেছনা তাকে। ডাঃ মেহেদি ছেলের মাকে বুজালেন, এই মুহুর্তে আপনার ছেলের বউকে বাঁচাতে হলে আপনার ছেলের রক্ত খুবই দরকার, নয়তো ছেলের বউ মারা যাবে। শাশুড়ী সাফ জানিয়ে দিলেন, বউ মারা গেলে ছেলেকে আবার বিয়ে করিয়ে বাড়িতে নতুন বউ নিয়ে আসব। আমার ছেলেকে রক্ত দিতে দিবোনা। ডাঃ মেহেদি হাসান হতাশ হয়ে ডাঃ জাহাঙ্গীর আলমকে ফোন করে ঘটনাটি জানান। রোগীকে রেফার করার সময় ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম অর্জুন এর মোবাইলটি চেয়ে নিয়ে নাম্বারটি ডায়াল করে রেখেছিলেন। ডাঃ মেহেদি হাসানের কলটি কেটে দিয়ে ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম অর্জুন এর নাম্বার এ কল দিলেন। রিসিভ করা মাত্রই ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম বললেন অর্জুন তুমি কোথায় আছো এখন? আমি হাসপাতালের সামনের হোটেলে আছি, আপনি কে? পরিচয় দিয়ে তিনি বললেন তোমার স্ত্রী মারা যাচেছ। তাড়াতাড়ি গিয়ে রক্ত দাও। একথা শোনার পর লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল ফোন  বন্ধ করে দেয় অর্জুন। এতোদিনের মানুষটি বাচ্চা প্রসবের পর মারা যাচেছ, এটা ভাবতে ভাবতে অর্জুন হোটেলের বাহিরে বের হতেই হাসপাতালের এক কর্মচারী তাকে ধরে ফেলে। অর্জুনকে ডাঃ মেহেদি হাসানের কাছে নিয়ে যান। অবশেষে এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ হলো। ইতিমধ্যে গাইনি কনসালটেন্ট ডাঃ হালিমা নাজনীনও ফয়সাল আহমেদ এসে হাজির হলেন। ডাঃ হালিমা নাজনীন জানান রোগীকে রক্ত দিয়ে স্টাবল করে আগামীকাল সকালে রিটেইনড প্লাসেন্টা বের করে দিবেন এবং আরো রক্ত লাগবে।  ডাঃ ফয়সাল বললেন  রক্ত যত ব্যাগ লাগুক সমস্যা নেই। হাফ ছেড়ে বাচা গেল। ফয়সাল আহমেদ মুমূর্ষ এ রোগীর জন্য  ও পজিটিভ রক্ত প্রয়োজন লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন। একজন ডোনার পাওয়া গেল, সকাল বেলা যোগাযোগ করা হবে বলে ডাঃ জাহাঙ্গীর আলমকে ফয়সল আহমেদ জানান। রবিবার আশুরার বন্ধ হলেও কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হাসপাতালের বহিঃবিভাগ খোলা রাখা হলো। সকাল থেকেই আকাশ মুখ ঘোমড়া করে বসে আছে। এই বুঝি বিষাদময় কোন ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ  করেই ডাঃ এস এম মেহেদী হাসান ডাঃ জাহাঙ্গীর  আলমকে ফোনে জানালেন স্যার রোগীর সার্ভাইক্যাল অস বন্ধ হয়ে গেছে।  জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া ছাড়া প্লাসেন্টা বের করা সম্ভব না। সদর হাসপাতালে অ্যানেসথেটিস্ট নেই। সিলেট ওসমানী মেডিকেল  কলেজ হাসপাতালে রেফার করতে হবে। রেফার করার কথা বলাতেই রোগীর শাশুড়ি বলে উঠেন তারা সিলেট যেতে পারবেন না।  বাড়ি চলে যাবেন। বাড়ি নিয়ে গেলে রোগীর মারা যাবে বলাতে শাশুড়ি বলেন, বউ মারা গেলে আবার ছেলেকে বিয়ে করিয়ে নতুন বউ নিয়ে আসবো,সমস্যা নেই।  এই রোগীকে হাত ছাড়া করা যাবে না। ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম  যোগাযোগ করলেন সদর হাসপাতালের ইউ এইচ অ্যান্ড এফ পি  ডাঃ দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর সাথে।  তিনি আবার অ্যানেসথেটিস্ট পাশাপাশি সহযোগীতা চাইলেন। তিনি আশ্বাস দিলেন ব্যাপারটি দেখছেন এবং গাইনী কনসালটেন্ট ডাঃ হালিমা নাজনিন এর সাথে এখনই কথা বলবেন। ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম প্রয়োজন হলে সদর হাসপাতালের বাহিরে কোন প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে চিকিৎসা দেয়ার জন্য ডাঃ দেলোয়ার হোসেনকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে জানান,চিকিৎসা ব্যায় যত হোক সব খরচ বহন করা হবে। ডাঃ দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ও গাইনী কনসালটেন্ট এসে সিদ্ধান্ত দিলেন দুই ব্যাগ রক্ত রেডি রেখে সদর হাসপাতালে ডিপ সিডেশন অথবা স্পাইনাল অ্যানেসথেশিয়া দিয়ে প্লাসেন্টা বের করা হবে। ফয়সাল আহমেদ ও তার টিম ঝাপিয়ে পড়লেন। চার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের জন্য। যারা চার ব্যাগ রক্ত দিলেন তারা হলেন, এ্যাডভোকেট অপু, সদর হাসপাতালের স্টাফ জসিম, ফয়সাল আহমেদের ছেলে তানভীর হাসান পলাশ, ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে নাম না জানা আরো একজন ডোনার। ফয়সাল আহমেদের ইচছা থাকা সত্ত্বেও বয়সের কারনে চিকিৎসক উনার কাছ থেকে রক্ত নেননি। সব আশংকা দূর করে দিয়ে দুপুর ১.২০ মিনিটে ডাঃ দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ডাঃ জাহাঙ্গীর আলমকে  ফোন করে জানান স্পাইনাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে প্লাসেন্টা সাকসেসফুলি বের করা হয়েছে, রোগী ভালো আছে। সমস্যা নেই। ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম সংবাদটি শুনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলেন, আমাদের সবার ছোট ছোট সহযোগীতার ফলে একটি ছোট্ট বাচচাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। তিনি আরো বলেন আমরা এভাবেই অর্জন করবো এস ডি জি। আশা করি সবাই সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিবেন। ডাঃ জাহাঙ্গীর আলমের মতো এভাবে যদি সকল ডাক্তাররা রোগীদের সেবায় এগিয়ে আসেন তাহলে অসহায় গরীব রোগীদের দুঃখ ও চিকিৎসাসেবা অনেকাংশেই নিশ্চিত হবে। ধন্যবাদ  ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম এবং ধন্যবাদ ডাঃ দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী, ডাঃ এস এম মেহেদী হাসান,ডাঃ হালিমা নাজনীন,ডাঃ ফয়সাল আহমেদ ও সিএসবি  শিপ্রা রায়কে।


     এই বিভাগের আরো খবর