,

৪ মাতব্বর যেন খাগাউড়া গ্রামের আতংক! ইউএনও’র হস্তক্ষেপে মাতব্বরদের দৌড়ঝাপ

পঞ্চায়েতে উঠতে হলে টাকা গুনতে হয়

নিজস্ব প্রতিনিধি ॥ বাহুবল উপজেলার ১নং স্নানঘাট ইউনিয়নের উত্তরের শেষ প্রান্তের গ্রাম খাগাউড়া। এই গ্রামেরই বাসিন্দা বাংলাদেশের সামনের সারির রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাহুবলের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কমান্ডেন্ট মরহুম লতিফুর রহমান চৌধুরী (মানিক চৌধুরী), তারই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের এমপি এডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, তারই চাচা হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম কবি আফজাল চৌধুরী, হবিগঞ্জ জজ কোর্টের বর্তমান বিজ্ঞ পিপি এডভোকেট সিরাজুল হক চৌধুরী, পুলিশ বিভাগের বর্তমান ডিআইজি কৃষ্ণপদ রায় সহ অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জন্মস্থান এ গ্রামে। কিন্তু এ গ্রামে বসবাসকারীদের মাঝে মানবাধিকার লংঘনের মত ঘটনা ঘটবে তা ভাবনারও অতীত। ওই গ্রামে চলছে চার মাতব্বরের দুঃশাসন। তারা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে এবং গ্রামের সরকারি জলমহালের বিশাল অঙ্কের টাকা নিতে  খেয়াল-খুশিমতো বিচার সালিসের মাধ্যমে লোকজনকে সমাজচ্যুত করাসহ বছরের পর বছর নানাভাবে নির্যাতন করছেন । ঐ গ্রামে প্রায় দেড় হাজার বাসিন্দার খাগাউড়া গ্রাম বাহুবলের ভাটি অঞ্চল নামে অনেকের কাছে পরিচিত । গ্রামটিতে রয়েছে একটি বড় জলমহাল। এ জলমহালের মাছ বিক্রি থেকে বছরে আয় হয় প্রায় ৪০-৪৫ লাখ টাকা। সব টাকা গ্রামের চার মাতব্বরসহ কিছু লোক ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে অবৈধভাবে ভোগ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর নেমে আসে অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতন। প্রতিবাদকারীকে করা হয় সমাজচ্যুত, তাদের গ্রামে আসতে দেওয়া হয় না। গ্রামে এলে গুনতে হয় জরিমানা। পূজা-পার্বণ ও আত্মীয়-স্বজনের জানাযায়ও অংশ নিতে দেওয়া হয় না। মাতবরদের কথা না শুনলে বা তাঁদের দলে যোগ না দিলে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়, ঘরছাড়া বা একঘরে করে রাখা হয়। দেহ ব্যবসার অপবাদ দিয়ে নিঃস্ব করে দেওয়া হয় পরিবার বা মানুষজনকে। সমাজচ্যুত করা ব্যক্তিকে সমাজে ফিরতে হলে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে খুশি করতে হয় মাতবরদের। কারো মা-বাবার মৃত্যু উপলক্ষে অনুষ্ঠানে কাদের দাওয়াত দেওয়া যাবে, সে সিদ্ধান্তও নিতে হয় মাতব্বরদের কাছ থেকে। সিদ্ধান্ত অমান্যকারীকে গ্রামছাড়া করা হয়। অথচ এই গ্রামে জন্ম স্বাধীনতা পদক পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর মতো আলোকিত ব্যক্তির। চার মাতব্বরর হলেন খাগাউড়া গ্রামের মৃত লোদাই মিয়ার পুত্র শওকত মিয়া, মৃত আব্দুর নুরের পুত্র শাহ গেদা মিয়া, মৃত শওকত আলীর পুত্র আব্দুস শহীদ ও মৃত আছাব মিয়ার পুত্র  আব্দুল মালিক ওরফে সেগেন মিয়া। খাগাউড়া গ্রামের মহিবুর রহমান হিরা জানান, গ্রামের মাতবরদের কু-কর্মের প্রতিবাদ করায় তাঁকে সমাজচ্যুত করা হয়। তিনি মাতব্বরদের দেড় লাখ টাকা দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেন এবং মাতব্বররা তাঁকে শর্ত দেন, ‘তুমি টাকা দিয়ে গ্রামের পঞ্চায়েতে উঠেছ মাত্র; কিন্তু তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারবে না। কারণ সেও পাঁচের (পঞ্চায়েত) বাহিরে। যদি কথা বলো, তাহলে আবার জরিমানা দিতে হবে।’ এসব কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন হিরা। একই গ্রামের জালাল উদ্দিনের পুত্র জনাব আলী কাঁদতে কাঁদতে জানান, মাতবরদের অপ-কর্মের প্রতিবাদ করায় তিন-চার মাস আগে তাঁকে গ্রামছাড়া করা হয়। ঘোষণা দেওয়া হয়, তাঁকে ধরে যে পঞ্চায়েতের মুখোমুখি করে দিতে পারবে তাঁকে নগদ ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। তখন তাঁর দাদার ম”ত্যু হলেও জানাযা ও দাফনে তিনি অংশ নিতে পারেননি কারনে । অনুসন্ধানে আরো  জানা যায়, এসব ঘটনার মূল কারণ গ্রামের জলমহাল। জল মহালের মাছ বিক্রি করে প্রতি বছর ৪০-৪৫ লাখ টাকা আয় হয়। টাকাগুলো গুটিকয়েক লোকে ভাগ করে নেয়। যদি পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সৎ, সাহসী লোকদের ওপর খড়্গ না চাপানো যায়, তবে তাঁরা ওই বিষয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। ফলে সমস্যাগুলো মাতব্বররা ইচ্ছামতো বানিয়ে এই অপশাসন চালিয়ে যাচ্ছেন সাত-আট বছর ধরে। খাগাউড়ার প্রদীপ সূত্রধর কাঁদতে কাঁদতে জানান, তাঁর ওপর গ্রাম্য মাতবরদের নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি নিজ বাড়িতে পূজায় অংশ নিতে পারেননি। বাড়ির ফসলাদি কেটে নিয়ে যায় মাতব্বরদের লোকজন। অর্ধাহারে-অনাহারে গ্রামের বাইরে দিন কাটছে তাঁর। গ্রামের জনাব আলী বলেন, ‘গ্রামের একজন সদস্য হিসেবে জলমহালের হিসাব চাইতে গিয়ে আমার ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। আমাকে বের করে দেওয়া হয় গ্রাম থেকে। প্রায় তিন বছর আগে চার বছরের মেয়ে তারিন আর ৩২ দিনের ছেলে আরিয়ানকে রেখে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। আজ পর্যন্ত বাড়িতে গিয়ে তার সন্তানদের দেখতে পারেননি। গ্রামের আশ-পাশে গেলেই মাতব্বরের লোকজন তাকে মারধর শুরু করে।’ মঞ্জু মিয়া নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘তিনি বিয়ে করার সময় মাতব্বরদের কথার অমান্য করে গ্রামের একজনকে দাওয়াত করেন। এ কারণে তাকে গ্রামছাড়া করা হয়েছে। এমনকি তিনি দুই বছর ধরে বিয়ের পরদিন থেকেই গ্রামের বাইরে। রাতের আঁধারে কোনো কোনো দিন বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীর সাথে দেখা করে ভোররাতে গ্রামের কেউ দেখার আগেই চলে আসেন।’ সম্প্রতি খাগাউড়ার জনাব আলীর লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সরেজমিনে গিয়ে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শোনেন। এরই ভিত্তিতে ওই চারজনের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছে উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু তাঁরা নোটিশে সাড়া দেননি। বাহুবল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা গ্রামে গিয়ে বিস্তারিত জেনে মর্মাহত হয়েছি। বিবাদীরা নোটিশের জবাব দেয়নি এবং শুনানির দিন আসেনি। তারা না এসে অপরাধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বাহুবল উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বলেন, ‘আমরা প্রশাসনসহ বিষয়টি দেখছি।’ এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে চার  মাতব্বরের মধ্যে একজন আব্দুস শহীদকে পাওয়া যায়। তিনি ‘আমি ত ইতা জানি না’ বলেই সংযোগ কেটে দেন।


     এই বিভাগের আরো খবর