,

এলএনজি ও কয়লা সংকটে বিবিয়ানায় অতি উৎপাদন

ঝুঁকিতে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র

সময় ডেস্ক ॥ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হতে দেরি এবং বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা উধাওয়ের প্রেক্ষাপটে দেশজ গ্যাস উত্তোলন বাড়িয়েছে সরকার। কয়লা সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সক্ষমতার বেশি গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র নবীগঞ্জ উপজেলার বিবিয়ানা থেকে। এর ফলে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ৪০ শতাংশের জোগানদাতা গ্যাসক্ষেত্রটির গুরুতর ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পেট্রোবাংলা এবং সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সমুদ্রে এলএনজিবাহী জাহাজ প্রায় সাড়ে তিন মাস অপেক্ষমান রয়েছে। ছয় দফা ঘোষণা দেয়ার পরও গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করা যায়নি রূপান্তরিত গ্যাস। সমুদ্র তলদেশে পাইপলাইনে ছিদ্রসহ কারিগরি ক্রটির কারণে বিতরণ পাইপলাইনে যুক্ত হচ্ছে না এলএনজি। যার ফলে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার ওপর চাপ পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাচাইবাছাই ছাড়াই এ ক্ষেত্র থেকে বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানায়, গত কয়েকদিন ধরে বিবিয়ানা থেকে প্রায় ১ হাজার ৩৪০ মিলিয়ন থেকে ১ হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করছে গ্যাসক্ষেত্রটির খনন কাজ পরিচালনায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরন। সর্বশেষ বুধবারও ১ হাজার ৩৪১ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস উৎপাদন করা হয়। অথচ এ ক্ষেত্রের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে উৎপাদন করা হচ্ছে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে ১৪১ মিলিয়ন ঘনফুট বেশি। পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদন প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে দৈনিক প্রায় ২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। কয়লা সংকটের পর দৈনিক প্রায় ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু বিবিয়ানা থেকে ১৪০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস তোলা হচ্ছে। গত তিন মাসের প্রতিবেদন বিশ্লেষনে দেখা যায়, গত ৫ মে মৌলভীবাজারের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১ হাজার ২৫১ দশমিক ৮ মিলিয়ন, ২১ জুন ৮৯০ মিলিয়ন, ১ জুলাই ১ হাজার ৩০১ মিলিয়ন, ১০ জুলাই ১ হাজার ৩০২ মিলিয়ন, ১ আগস্ট ১ হাজার ৩৪১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। গত জুলাইতে কয়লা সংকট দেখা দেয়ার পর এভাবে ক্রমাগতভাবে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট প্রকৌশলগত নকশা ও ছক মেনে গ্যাস উত্তোলন করতে হয়। কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদনের সর্বোচ্চ সীমা ওই নকশা-ছক বিবেচনায় নিয়ে নির্ধারিত হয়। নকশার বাইরে গিয়ে গ্যাস উত্তোলন করলে গ্যাস কূপ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা থাকে। এর ফলে একটি কূপ থেকে যতটুকু পরিমাণ গ্যাস তোলার সম্ভাবনা থাকে তার চেয়ে কম তোলা যায়। আবার দুর্ঘটনার ঝুঁকিও রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাসের মজুদ ও কারিগরি সক্ষমতা-স্থাপনা বিবেচনায় নিয়ে বিবিয়ানার সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদন বাড়াতে হলে নতুন করে নিরীক্ষা-মূল্যায়ন করতে হয়। কিন্তু সেটি হয়নি। যেভাবে উৎপাদন দ্রুত বাড়ানো হচ্ছে তা ঝুঁকিপূর্ণ। জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিবিয়ানার বর্তমান মজুদ অনুযায়ী বর্ধিত হারে গ্যাস উৎপাদন ক্ষতিকর। ২০১৫ সালের এপ্রিলে শেভরন গ্যাসক্ষেত্রটিতে দেড় ট্রিলিয়ন ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে জানায়  পেট্রোবাংলাকে। সব মিলিয়ে এতে ৭ ট্রিলিয়ন গ্যাস রয়েছে। ওই সময় শেভরন ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস উৎপাদন করতে চাইলেও কারিগরি ও মজুদ বিবেচনায় নিষেধ করেছিল পেট্রোবাংলা। উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) অনুযায়ী, খনির মোট মজুদের সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৫ শতাংশ গ্যাস উৎপাদন করতে পারে নিয়োগকৃত খনি উন্নয়ন ঠিকাদার কোম্পানি। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিবিয়ানার কূপে গ্যাসের চাপ ২০২১-২২ সালে দ্রুত কমে যাবে। সেক্ষেত্রে দ্রুত উৎপাদন বাড়ালে ক্ষেত্রটিকেও দ্রুত পরিত্যক্ত হওয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। সেক্ষেত্রে ২০১৯-২০ সালেই গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস শেষ হয়ে যাবে। তখন দেশ আরেকটি সংকটের মুখোমুখি হবে। বিবিয়ানায় উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ ঃ দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির প্রথম চালানসহ জাহাজ এসেছে গত এপ্রিলে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ওই গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আসবে এমন আশাও দিয়েছিলেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এলএনজি টার্মিনাল থেকে স্থলভাগে টানা পাইপলাইনে ছিদ্রসহ নানা ক্রটির কারণে সেই এলএনজি এখনও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়নি। অথচ এ গ্যাসের আশায় বড় বিনিয়োগ করেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। গত বছর নতুন করে ৩ হাজার শিল্প সংযোগও দেয়া হয়। সার্বিকভাবে শিল্পে বেড়েছে গ্যাসের চাহিদা। এর মধ্যে বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা উধাওয়ে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন। ফলে লোডশেডিং এবং লো ভোল্টেজ সমস্যায় ভুগছে উত্তরের জেলাগুলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। সিরাজগঞ্জ গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, কয়লার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে পুষিয়ে নেয়া হবে। আর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মোঃ ফয়েজউল্লাহ জানান, বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।


     এই বিভাগের আরো খবর