,

৪৮ বছর ফিরিয়ে গেলেও নবীগঞ্জে শহীদ ধ্রুবের কবর সনাক্ত করা যায়নি

মতিউর রহমান মুন্না ॥ আজ ৪ঠা ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনানী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র ৪৮তম শাহাদাত বরন দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে নবীগঞ্জ শহর মুক্ত করতে পাক হানাদারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন এই বীর সেনানী। স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিবাহিত হলেও এই বীর শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে কোন প্রদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমন কী বছরের পর বছর ধরে তার শাহাদাত বার্ষিকী পালন করতে কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়না। অযতœ অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই বীর সেনানীর শেষ স্মৃতি সমাধিটুকুও। ধ্রুব’র সহযোদ্ধা ও একাত্তরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রশীদ বাহিনীর প্রধান মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশিদ ‘‘এ প্রতিবেদকের’’ সাথে আলাপকালে অশ্রুসিক্ত নয়নে ধ্রুব’র স্মৃতিচারণ করে তিনি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধে ধ্রুব’র অবদানের কথা বর্ণনা দিয়ে বলেন- ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজার, নবীগঞ্জ বাহুবলে শহীদ ধ্রুব মুক্তিাযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। ১৫ নভেম্বর নবীগঞ্জে আসে মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। তার পরপর গজনাইপুরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেই যুদ্ধে ধ্রুব’র বন্দুকের গুলিতে ৪ জন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। তারপর ধ্রুব নবীগঞ্জের চৌধুরী বাজারে রশীদ বাহিনীর সঙ্গীয় সদস্য হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে বাহুবল উপজেলায়ও মুক্তি বাহিনীর সাথে বীর সেনানী ধ্রুব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশিদের নেতৃত্বে রশীদ বাহিনীর ৩৫ সদস্য সহকারে নবীগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ৪ ডিসেম্বর ভোরে গিয়ে নবীগঞ্জে পৌঁছায় রশীদ বাহিনী। সেখানে অবস্থানকালে নবীগঞ্জে পাক-হানাদার বাহিনীর মূল ঘাটি হিসিবে চিহ্নিত নবীগঞ্জ থানাতে আক্রমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। মুক্তিবাহিনীর রশীদ,ধ্রুবসহ অন্যান্য সদস্যরা নবীগঞ্জ থানার গেইটের নিকটে যুদ্ধের জন্য চুড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করলে পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় পাক হানাদার বাহিনীর একটি গুলি তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র মাথায় লাগে। এতে নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কে প্রাণ হারায় মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। ওই যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে আরো ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। পরে মুক্তি বাহিনী পিছুহটে। তখন যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র লাশ নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কে পড়ে থাকে। পচন ধরে ধ্রুবের লাশে । পরবর্তীতে যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ৬ ডিসেম্বর নবীগঞ্জ থানাকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা রশীদের দাবী, নবীগঞ্জ স্বাধীন হওয়ার পর বর্তমান নবীগঞ্জ থানার গেইটের সামনেই চাপ মাটি দেয়া হয় ধ্রুবকে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন মহল থেকে ধ্রুব’র স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার আশ্বাস দিয়ে আসলেও স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এনিয়েও চরম ক্ষোভ ঝাড়েন মুক্তিযোদ্ধা রশীদ। একাত্তরে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রশীদ বাহিনীর প্রধান মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশিদ আরো বলেন, মারা যাওয়ার পূর্বে যদি দেখে যেতে পারি শহীদ ধ্রুব’র নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে তাহলে মরার পরেও শান্তি পাবো। এবং ধ্রুত আত্মার শান্তি পাবে। জানা যায়, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র সমাধিটি আজও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে ফুল দিয়ে সম্মান জানানো হয় মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের। কিন্তু ঠিকানা বিহীন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ধ্রুবের সমাধি আজও অচিহ্নিত অবস্থায় নবীগঞ্জ থানা সংলগ্ন নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের পাশে রাজনগর গ্রামের কবর স্থানের এক পাশে পড়ে আছে। একজন টগবগে যুবক যার তখনও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি কিন্তু দেশ মার্তৃকার টানে ধ্রুব অপরিণত বয়সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। অনেকেই বলেন শ্রীমঙ্গলের কোন এক চা-বাগানের দরিদ্র শ্রমিক পিতা মাতার সন্তান ছিল শহীদ ধ্রুব। এক দিকে ঠিকানা বিহীন, অন্যদিকে সমাধি অচিহ্নিত, অবহেলিত এই কি ছিল শহীদ ধ্রুবের স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে ‘‘এ প্রতিবেদকের’’ সাথে আলাপ হয় সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে। দিনারপুর কলেজের অধ্যক্ষ তনুজ রায় বলেন, যুদ্ধের ময়দানে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও তার সঠিক সমাধিস্থল নির্ধারণ করা যায়নি এবং তার স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো স্মৃতিস্বারক বা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। নবীগঞ্জবাসীর দাবী অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে শহীদ ধ্রুব’র নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হউক। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও ধ্রুব’র সমাধিস্থল সনাক্ত করতে না পারার ব্যাপারে ব্যর্থতা রয়েছে স্বীকার করে নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের আহবায়ক ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম “এ প্রতিবেদকের সাথে আলপাকালে বলেন’’ শহীদ ধ্রুব সমাধিস্থল সনাক্ত করা যায়নি বলে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ের ভিতরে ধ্রুব’র সমাধিস্থল সনাক্ত করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে দেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।


     এই বিভাগের আরো খবর