,

বাংলাদেশের বাজারে করোনার বড় ধরণের প্রভাব পরার আশঙ্কা

সময় ডেস্ক ॥ করোনা ভাইরাসে চীনে মৃতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে দেশটির অর্থনীতি। থমকে গেছে উৎপাদন ও রপ্তানি। এমন অবস্থায় দেশটির অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশের বাজারে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ শিল্পপণ্য আমদানির সবচেয়ে বড় বাজার হলো চীন। দেশটি থেকে অনেক খাদ্যপণ্যও আসে দেশের বাজারে। পরিস্থিতির আরো সঙ্কটাপন্ন হলে বাংলাদেশের বাজারে বড় ধরণের প্রভাব পড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন। ইতিমধ্যেই দেশের বাজারে চীন থেকে আমদানিনির্ভর আদা ও রসুনের কেজি ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। হু হু করে বাড়ছে মাস্কের দাম। এর পাশাপাশি পোশাক, চামড়া ও ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতেও প্রভাব পড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও পায়রাবন্দরসহ বড় বড় অবকাঠামো খাতে কাজ করছেন চীনের নাগরিকরা। এসব প্রকল্পে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে। তবে দেশের অর্থনীতিতে এখনই এই ভাইরাসের কোন ক্ষতিকারক প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এ বিষয়ে শুরু থেকে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ মুহূর্তে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হচ্ছে। এছাড়া গত দশ বছরে একক দেশ হিসেবে চীন সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে এদেশে। সব মিলিয়ে এদেশে চীনের প্রায় ১০ হাজার নাগরিক বিভিন্ন ব্যবসা ও পেশায় নিয়োজিত। এ কারণে চীনের করোনা ভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হলে কিভাবে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে সুরক্ষা দেয়া যাবে সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হচ্ছে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক করা হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতির একটা বড় অংশ চীনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ আমরা চীন থেকে যেমন আমদানি করি, তেমনি আবার রপ্তানির বিষয়ও আছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী অংশীদার। চীন থেকে আমদানি হয় না এমন তালিকা খুবই কম। স্ক্রু ড্রাইভার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্য ও তিন-চারটি মসলা এমন পণ্যের সংখ্যা অসংখ্য। বাসা-বাড়ি, অফিস, কলকারখানা, যানবাহনসহ সব ক্ষেত্রেই চীনা পণ্য ও সেবা ব্যবহার হচ্ছে। খেলনা, প্লাস্টিক পণ্য, খাদ্য থেকে শুরু করে ভারী শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হয় চীন থেকে। আবার রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মেশিনারিজ, কাঁচামাল, প্রাথমিক পণ্যও আমদানি হয় দেশটি থেকে। সামগ্রিকভাবে দেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশের বেশি আমদানি হয় চীন থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩.৬৪ বিলিয়ন ডলার। যা ওই অর্থবছরের মোট আমদানির ২৬.১ শতাংশ। অন্যদিকে চীনে পাট ও পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োজিত চীনের নাগরিকদের আপাতত নিজ দেশে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও পায়রাবন্দরসহ বড় বড় প্রকল্পে নিয়োজিত চীনা নাগরিকরা যারা নববর্ষ উদযাপনে দেশে গিয়েছেন তাদের আপাতত না আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আর যারা একান্ত প্রয়োজনে চীন থেকে আসছেন তাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ১৪ দিন বিশেষ পর্যবেক্ষণে রেখে তাদের কাজে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
এদিকে করোনা ভাইরাসে দেশের কারও এ পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া না গেলেও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে দেশের অনেক বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প। এগুলোর মধ্যে সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্পও রয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, চীনা প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারিতে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোয় ইতিমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এগুলোর প্রত্যাশিত অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা ভাইরাস। এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যেই অগ্রগতির হারে উদ্বেগজনক মাত্রার পতন ঘটবে।
জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হলে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর প্রয়োজনীয় উপকরণসহ সব ধরনের শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি হয় চীন থেকে। এই বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকরা। বিশেষ করে যারা ওভেন পোশাক রপ্তানি করেন। কারণ, ওভেন পোশাকের ৬০-৬৫ শতাংশ কাপড় আমদানি হয়, যার একটি বড় অংশ চীন থেকে আসে। বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এর জন্য কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ১ হাজার ২১৭ কোটি ডলারের। আমদানি হওয়া এই কাঁচামালের বড় অংশ চীন থেকে আসছে বলে জানালেন পোশাকশিল্পের মালিকরা।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৩১ কোটি ডলারের পাটের সুতা রপ্তানি হয়েছে। পাটসুতার বড় ক্রেতা তুরস্ক। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীন। দেশটি ৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের পাটসুতা আমদানি করেছে। ১ কোটি ১৬ লাখ ডলারের কাঁচা পাটও কিনেছেন দেশটির ব্যবসায়ীরা। ফলে করোনাভাইরাসের কারণে পাট খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চীন থেকে সবচেয়ে বেশি কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, প্রস্তুত পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে, যা মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পদ্মাসেতুতে কর্মরত চীনা নাগরিকরা আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে না ফিরলে কিছু সমস্যা হবে।
বিজিএমইএর এক কর্মকর্তা বলেন, চীন থেকেই বাংলাদেশের পোশাক খাতের কাঁচামাল সিংহভাগ আমদানি হয়। সে কারণে এসব পণ্য নির্ধারিত সময়ে আসছে না। এর প্রভাব প্রথমে উৎপাদনে পড়বে। এরপর কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত পণ্য রপ্তানি পিছিয়ে যাবে। তাতে পুরো সরবরাহব্যবস্থাই ভেঙে পড়তে পারে। এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চীনের ভাইরাস সংকট দীর্ঘায়িত হলে আমরা পোশাকসহ শিল্প খাতের যেসব কাঁচামাল আমদানি করি, তাতে সমস্যা দেখা দেবে। প্রয়োজনে বিকল্পও ভাবতে হবে। পরিস্থিতি জটিল হলে কিছু ক্রেতা চীনের বিকল্প খুঁজবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনা আছে। তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।


     এই বিভাগের আরো খবর