,

বিয়ে করতে দেশে এসে ৯ জনকে নিয়ে পরপারে চলে গেল ইমন

মতিউর রহমান মুন্না ॥ ইমন খাঁন মাত্র কদিন আগেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার থেকে দেশে এসেছেন বিয়ে করবেন বলে। বিয়ে অনেকটা পাকাপোক্তও হয়েছিল। বেশ ধুমধাম করেই চলছিল বিয়ের প্রস্তুতি। ভোরে উঠেই নারায়াণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে যাচ্ছিলেন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। কিন্তু সেই যাত্রা থেমে গেলো নবীগঞ্জে এসেই। বিয়ের বাদ্য বাজার আগেই থেমে গেল জীবনই। হবু স্ত্রীকে আর আংটি পরানো হলো না ইমনের। বিয়ের দিন তারিখ নির্ধারণ করতে হবু শ্বশুরবাড়ি পৌঁছানোর আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন ইমন খাঁনসহ ১০ জন। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নবীগঞ্জ উপজেলার কান্দিগাঁও নামকস্থানে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। তাদের প্রাইভেট মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা লেগে মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে নারীসহ ৮ জন নিহত হন। গুরুতর আহত ৫ জনকে আশংকাজনক অবস্থায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ শিশুসহ ২ জন মারা যান। আহত ৩ জনকে মূমুর্ষ অবস্থায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ঘটনার পরপরই মহাসড়কে আশপাশের শত শত লোকজন উপস্থিত হলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। খবর পেয়ে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল হাসান, নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ^জিত কুমার পাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার ভোরে নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা পাগলা কুসুমপাড়া এলাকা থেকে কাতার প্রবাসী ইমন খাঁন (২৬), তার পিতা, ভাই, ভাবি, বন্ধুসহ পরিবারের ১৩ জন সদস্য নিয়ে (হাইএস) মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো চ ১৯-৫৪৬২) যোগে হবু বধুকে আংটি পড়াতে সিলেটের সুনামগঞ্জের দিরাই জগদল গ্রামের উদ্দ্যোশে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে নবীগঞ্জের দিনারপুর অঞ্চলের দূর্ঘটনা কবলিত এলাকা হিসেবে পরিচিত কান্দিগাঁও নামকস্থানে পৌঁছামাত্র দ্রুতগামী প্রাইভেট মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে সড়কের পাশের একটি বড় গাছের সাথে ধাক্কা লেগে ধুমড়ে-মুচড়ে যায়। এ সময় ঘটনাস্থলে নিহতরা হলেন হবু বর ইমন খাঁন (২৬), তার পিতা আব্বাস উদ্দিন খাঁন (৫০), তার ভাই মাহবুব হোসেন রাব্বি (২১), মামাতো ভাই রাজিব হাসান (২৫), খালাতো ভাইয়ের বউ আসমা বেগম (২৮), খলিল মিয়া (৫১), ইমরান মিয়া (২৪), মোঃ মহসিন (৫৭)। পরে সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইমনের মামী সুমনা বেগম(২৮), ইমনের মামাতো বোন ও নিহত সুমনা বেগমের শিশু সন্তান খাদিজা আক্তার (৪) মারা গেছেন। দূর্ঘটনায় গুরুতর আহতরা হলেন রফিকুল ইসলাম (৫৫), আবুল হোসেন (৫০), গাড়ি চালক নাদিম মাহমুদ (৩৬)। তাদের আশংকাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দূর্ঘটনার খবর পেয়ে গোপলার বাজার তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ, শেরপুর হাইওয়ে থানার পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশগুলো উদ্ধার করে। পরে নিহতদের লাশ শেরপুর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেলে নিহতদের আত্মীয়স্বজন শেরপুর হাইওয়ে থানাতে উপস্থিত হয়ে লাশ সনাক্ত করেন। এ সময় বর ইমনের মামাতো ভাই আব্দুল আহাদ বলেন, নিহতরা একটি বিয়ের পাত্রী দেখার জন্য সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে যাচ্ছিলেন তিনি তার লাশগুলো সনাক্ত করেন। নিহত ইমনের মামাতো ভাই শাহাদাত হোসেন জানান, ইমনের বন্ধু রাজিবেরও বিয়ে দিন-তারিখ ঠিক ছিল ২৬ মার্চ। এই মর্মান্তিক ঘটনা কোনো ভাবেই মেনে নেয়ার নয়, ইমন ও রাজিবের ইচ্ছে ছিল তারা একই মাসে বিয়ের পিরিতে বসবে। কিন্তু বিধি বাম মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় কেড়ে নিল তাদের তর তাজা প্রাণ। কান্দিগাঁও জামে মসজিদের মুয়াজ্জিম আমীর আলী জানান- তিনি নামাজ পড়ে হাটাহাটি করছিলেন, এ সময় হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে দৌড়ে এসে দেখেন একটি মাইক্রোবাস গাছের সাথে ধাক্কা লেগে মর্মান্তিক দূর্ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি লাশ মাটিতে পড়ে আছে, ভিতরেও কয়েকজন লোক ছটপট করছিল। এ সময় তার শোর চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। তিনি আরো বলেন, দুর্ঘটনার সময় অনেকের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিচ্ছিন্ন্ন হয়ে যায়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভোরে ফজরের নামাজের পর গাড়িতে বসে একটু চোখ মুঝে আসছিল। এ সময়ই দূর্ঘটনা ঘটে। এরপরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে আমি নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি।’ তিনি জানান, ‘গাড়িতে যারা ছিল সবাই আত্মীয়স্বজন। সবাই বরিশাল বিমানবন্দর থানার মুদ্রকাঠি গ্রামের বাসিন্দা। তবে তাঁরা বেশ কিছুদিন ধরে নারায়ণগঞ্জের পাগলা ফতুল্লা মুসলিম পাড়ায় বসবাস করে আসছিলেন।’
নিহত ইমন খানের ছোট ভাই আব্দুল্লাহ জানান, তার বড় ভাই ইমন বিদেশে থাকে। বিয়ে করার উদ্দ্যোশে গত এক মাসে ছুটিতে দেশে আসে। ইমনকে ধুমধাম করে বিয়ে দেয়ার পরিকল্পনায় আয়োজন শুরু করে। সিলেটের সুনামগঞ্জের কনে পছন্দ হলে গতকাল শুক্রবার কনেকে আংটি পড়ানোর অনুষ্ঠানে দূরের পথ হওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে একটি ভাড়া করা গাড়িতে ১৩ জন সুনামগঞ্জের উদ্দ্যোশে রওনা হয়। কিন্তু কনের বাড়ি যাওয়ার আগে গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে দূর্ঘটনার এমন সংবাদ পাই। ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর আমাদের বাড়ির লোকজন লাশ আনতে রওনা হয়। একটি সড়ক দূর্ঘটনায় ইমন ভাইয়ের বিয়ের উৎসবের পরিবর্তে বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। আল্লাহর কাছে কি অপরাধ করলাম আমাদের পরিবারকে দুই টুকরো করে দিয়ে গেলো।’
শেরপুর হাইওয়ে থানার ওসি এরশাদুল হক ভূইয়া জানান, নারায়গঞ্জ থেকে ১৩ জন যাত্রী সুনামগঞ্জে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কান্দিগাঁও গ্রামে দূর্ঘটনাটি ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌছে হতাহতদের উদ্ধার করে, পরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। তিনি বলেন ঘটনাস্থলে ৮ জন মারা যায়। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো ২ জন মারা যায়। নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত কুমার পাল জানান, মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে অজ্ঞাতনামা ১ জন মহিলা ও ৭ জন পুরুষ ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো ২ জন মারা যায়। হতাহতদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগীতার আশ্বাসও দেন তিনি।


     এই বিভাগের আরো খবর