,

সালমান শাহ খুনের রাজসাক্ষী হতে ৭ কোটি টাকা দেয়ার চুক্তি ছিল, ঠকিয়েছে: রিজভী

সময় ডেস্ক ॥ ঢাকাই ছবির আলোচিত নায়ক সালমান শাহ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন কিছু দিন আগে মিডিয়ায় প্রকাশ করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। তদন্তে বলা হয়েছে, পারিবারিক কলহের কারণে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। এর জন্য পাঁচটি কারণও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তবে সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে সালমান শাহের পরিবার। সালমানের মা নীলা চৌধুরী বলেছেন, সালমান খুনের রাজসাক্ষী রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে পিবিআই প্রতিবেদন
তৈরি করেছে। তাই এটি অসম্পূর্ণ। তার এই বক্তব্যের সূত্র ধরে যুগান্তরের পক্ষ থেকে খোঁজ নেয়া হয়, কে এই ফরহাদ? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সালমান শাহ মৃত্যুর পরের বছর ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ নামের এক তরুণ গ্রেফতার হন। তখন বলা হয়েছিল, তিনি সালমান শাহের খুনের সঙ্গে জড়িত। পরে ওই খুনের মামলার রাজসাক্ষী হিসেবেও দাঁড় করানো হয় তাকে। বিষয়টি সে সময় বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। বেশ কিছু দিন পর জামিনে ছাড়া পেয়ে দেশ ছাড়েন সেই তরুণ। এরপর থেকে তার তথ্য থেকে যায় মিডিয়া কিংবা লোকচক্ষুর অন্তরালে।
দীর্ঘ ২৪ বছর পর পিবিআই যখন সালমান শাহ হত্যা মামলার নতুন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তখন আবারও আলোচনায় আসেন রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ। যুগান্তরের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করে জানা যায়, রিজভী বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন।
সেখান থেকে মুঠোফোনে তিনি যুগান্তরকে জানিয়েছেন, এ হত্যা মামলার সঙ্গে তার কতটুকু সম্পৃক্ততা ছিল কিংবা আদৌ ছিল কি না। রিজভী বলেন, আমাকে তখন রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য সাত কোটি দেয়ার চুক্তি ছিল। কিন্তু তারা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরী আমাকে ঠকিয়েছে। আমি এসব বিষয় পিবিআইকে বলেছি।
আসলে কী ঘটেছিল সেদিন? রিজভীইবা কেন রাজসাক্ষী হতে চেয়েছিলেন বা হয়েছিলেন? জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি কখনোই রাজসাক্ষী ছিলাম না। নাটক করেই আমাকে রাজসাক্ষী বানানো হয়েছে। এ পরিকল্পনায় নীলা চৌধুরী, ওসি বদরুলসহ অনেকেই জড়িত ছিলেন।
তখনকার প্রতিবেদনে উল্লেখিত ক্যান্টনমেন্ট থানা বা সিএমএম কোর্টে-আদালতে আমি কোনো জবানবন্দি দিইনি। আমি কোনো রাজসাক্ষী নই। বারবার আমাকে নিয়ে মিথ্যে কথাটা বলা হচ্ছে।
আদালতে যে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়া হয়েছে, সেটিও আমার নয়। আমার স্বাক্ষর জাল করেই এসব করা হয়েছে। আমার সঙ্গে ওয়াদার বরখেলাপ করা হয়েছে। আমাকে ৯ মাস জেল খাটানো হয়েছে।
কার সঙ্গে কিসের চুক্তি বা ওয়াদা ছিল? কী কারণে জেল খেটেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, আমি আসলে কিছুটা লোভে পড়েছিলাম। ঠিক লোভও বলব না, আসলে ভয়ে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। আমি সালমান শাহের ভক্ত ছিলাম, এখনো আছি। তখন আমার বয়স মাত্র ১৫ বছর।
আবেগে পড়ে প্রিয় নায়কের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছিলাম না। অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করেছি, সালমানকে খুন করা হয়েছে। আমার এই বিশ্বাসটাকে পুঁজি করে নীলা চৌধুরী আমাকে ঠকিয়েছে। সালমান ও তার পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
একদিন নীলা চৌধুরী আমাকে তার বাসায় যাওয়ার জন্য গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি পাঠায়। আমি গিয়ে দেখি সেদিন বাসায় সালমান শাহের কয়েকজন আত্মীয়, কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ বসে আছেন। আমাকে বোঝানো হয়, আমাকে গ্রেফতার দেখিয়ে খুনের মামলা পরিচালনা করা হবে।
যেহেতু কোনো সাক্ষী নেই, তাই আমাকে রাজসাক্ষী বানানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। এজন্য আমাকে সাত কোটি টাকা দেয়ার ওয়াদা করে নীলা চৌধুরী ও অন্যরা। প্রথমে আমি রাজি হইনি। পরে ভয়ে হোক কিংবা আবেগে পড়ে হোক, আমি রাজি হই। ওসি বদরুল বলেছিলেন, মাত্র দু’দিন আটক থাকতে হবে।
কিন্তু নীলা চৌধুরী বেঈমানী করল। দু’দিন পর আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হলো। দীর্ঘ নয় মাস আমি সেখানে বন্দি ছিলাম। আমার সঙ্গে পরিবারের কেউ যোগাযোগ করতে পারত না। মা-বাবা, ভাইবোন কারো মুখ দেখিনি নয় মাস।
নিজের ভুল বুঝতে পেরে পরে যেসব অফিসার কারাগারে আমার জবানবন্দি নিতে আসতেন তাদের কাছে সত্য ঘটনা খুলে বললাম। এরপর আমার জামিন হয়। আমার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য লন্ডন থাকেন। তাদের পরামর্শে আমি দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে আসি।
এ ঘটনার জন্য আপনার পরিবার থেকে নীলা চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন? জানতে চাইলে রিজভী বলেন, প্রথমত, সালমান শাহ তখনকার বেশ জনপ্রিয় একজন নায়ক ছিলেন। তার মৃত্যুরহস্য নিয়ে সবাই অন্ধকারে আছেন। এর মধ্যে অন্যায়ভাবে আমি ফেঁসে গেছি।
সব মিলিয়ে আমি ছাড়া পাওয়ার পর আমার পরিবার আর বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়নি। বিশেষ করে আমার বয়স তখন একেবারেই কম ছিল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা আমাকে পাঠিয়ে দেন লন্ডনে।
তাছাড়া আমার মামা ছিলেন ডিআইজি স্টাফ অফিসার। আমার পরিবারের পাশাপাশি তারও ইমেজের একটা বিষয় ছিল। তাই আইনি ঝামেলায় না গিয়ে সেটা থেকে আমাকে দূরে রাখতে চেয়েছে পরিবার।
এখন কেন তাহলে আপনি মিডিয়ায় মুখ খুলছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, এসব থেকে আমি দূরে থাকতে চাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন দেখলাম পিবিআইয়ের সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদন অস্বীকার করে সেখানে আমার নামও উচ্চারণ করেছেন, ঠিক তখনই আমার মনে হয়েছে মিডিয়াকে এবার সত্যটা জানানো দরকার।
পিবিআই কিন্তু আমার আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার নাম্বার নিয়েছে। আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি ভয়েস ম্যাসেজে আমার জবানবন্দি দিয়েছি। যা জানি সব বিস্তারিত বলেছি।
কিন্তু নীলা চৌধুরী প্রশ্ন তুলেছেন আমাকে নিয়ে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা কিছু বললে আমি আইনি ব্যবস্থা নেব। আইনজীবীর সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলেছি। যে নাটকের শিকার একবার হয়েছি সেটা ভুলে যেতে চেয়েছি। নতুন করে আবারও নাটক হোক সেটা তাকে করতে দেব না।
লন্ডনে রিজভীর কাছাকাছি থাকলেও নীলা চৌধুরীর সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। রিজভী বলেন, আমার বাসার খুব কাছেই থাকেন তিনি।
এখানে তিনি কী করেন সেটা বলে নিজের দেশের মানুষকে ছোট করতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে পারি, সালমান শাহের মতো এমন একজন মানুষ তার গর্ভে জন্মেছে এটা ভাবতে কষ্ট লাগে।
তুমুল জনপ্রিয় থাকা অবস্থায় ১৯৯৬ সালে ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটনে নিজ বাসায় মারা যান চিত্রনায়ক সালমান শাহ। প্রাথমিক তদন্তে সেটা আত্মহত্যা হিসেবে বলা হলেও পরে সালমানের মা হত্যা মামলা করেন।
এজন্য তিনি সালমানের স্ত্রী সামিরা, বন্ধু ডন’সহ চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন। দীর্ঘ ২৪ বছর পর সম্প্রতি পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে বলে সালমান আত্মহত্যাই করেছেন।


     এই বিভাগের আরো খবর