,

হবিগঞ্জের হাওরে ভাসমান বেডে সবজি আবাদ করে লাভবান কৃষক

নিজস্ব প্রতিনিধি ॥ হবিগঞ্জের হাওর এলাকায় একমাত্র ফসল বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল সবাই। এই ফসলের পর বর্ষাকালে চারদিকে শুধুই জল আর জল। মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে পড়ে স্থবির প্রায়। অনেকেই চলে যান শহরে বিকল্প কর্মসংস্থানের আশায়। আর কেউ কেউ হাওরে মাছ শিকারে লেগে পড়ে জীবন সংগ্রাম করে থেকে যান এলাকায়। তবে হাওর এলাকার এই চিত্র পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। বন্যাসহিষ্ণু ভাসমান বেডে সবজি আবাদ করে লাভবান হতে শুরু করেছেন কৃষকরা। এতে করে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে হাওরে। হবিগঞ্জের ভাটি এলাকা খ্যাত বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে বিসতৃর্ণ হাওর। বছরের ছয় মাস জল আর ছয় মাস স্থল। বছরের প্রায় ছয় মাস অলস কাটে ওই এলাকার কৃষকের দিন। জলাবদ্ধতার কারণে আবাদ না হওয়ায় হবিগঞ্জের বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, লাখাই ও নবীগঞ্জ উপজেলার হাওর এলাকায় অনেক জমি পতিত থাকতো। কিন্তু এখন বন্যাসহিষ্ণু ভাসমান বেডে সবজি চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে অনাবাদি জমিতে উৎপাদিত হচ্ছে বিষমুক্ত সবজি। কচুরিপানা দিয়ে তৈরি ভাসমান বেডে বিভিন্ন প্রকার সবজির ভালো ফলন হওয়ায় লাভের মুখ দেখছেন কৃষকরা। জলাবদ্ধতা এবং বন্যাদুর্গত এলাকার কৃষকরা যাতে এভাবে সারা বছর সবজি চাষ করতে পারে, তাই এ বছরও অনেকগুলো প্রদর্শনী প্লট করে দিয়েছে কৃষি বিভাগ। কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে অতিবৃষ্টি ও বন্যায় কখনও ডুববে না, সেচের প্রয়োজন পড়বে না, কীটনাশক দিতে হবে না, এমনকি সারেরও প্রয়োজন হবে না এমন সবজিক্ষেত এতদিন ছিল কৃষকদের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবে পরিণত করছে কৃষি বিভাগ। দুয়েকটি নয়, প্রায় অর্ধশতাধিক ভাসমান বেডে বিভিন্ন প্রকার সবজি আবাদ করেছেন জেলার হাওরের কৃষকরা। প্রায় সারা বছরই জলাবদ্ধতা থাকে এবং বন্যা ও বৃষ্টির জন্য যেসব এলাকার ক্ষেত পানিতে ডুবে থাকে, সেসব জায়গায় কৃষি বিভাগ প্রদর্শনীর মাধ্যমে কলাগাছের ভেলায় এবং কচুরিপানা দিয়ে বেড করে দিয়েছে। ভাসমান এসব বেডে আবাদ হচ্ছে লাউ, পুইশাক, লালশাক, মুলাশাক, ডাটাশাক, ঢেড়স ও বিভিন্ন প্রকার সবজি। জমিতে ধাপ পদ্ধতিতে ১২ রকমের সবজি চাষে দিন দিন বদলে যাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে যথেষ্ট লাভ হওয়ার কারণে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। কম জমিতে বেশি ফসল আবাদ সম্ভব হচ্ছে বলেও জানিয়েছে কৃষকরা। বানিয়াচং উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, প্রতিবছরই বন্যা, অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে উপজেলার প্রায় ৩৫০ হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধ থাকে। ক্ষেত তলিয়ে ফসল নষ্ট হয়। তাই সময়মতো ফসল আবাদ করা যায় না। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রান্তিক কৃষকরা। তবে ভাসমান বেডে সবজি আবাদ করে কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। ভাটিপাড়া গ্রামের কৃষক বিষ্ণ পদ দাস বলেন, ভাসমান বেডে যে সবজি চাষ করা যায়, আগে তাদের জানা ছিল না। কৃষি কর্মকর্তার অনুরোধে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ভাসমান সবজির বেড করেন। ফসল যা হয়েছে তা দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। তার এই ভাসমান সবজির খামার দেখে এলাকার অনেক চাষী নিজেদের উদ্যোগেই এভাবে চাষ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে বলেও জানান এই কৃষক। ২০১৪ সালে হাওর এলাকায় শুরু হয় এই পদ্ধতির সবজি চাষ। একই এলাকার কৃষক সুব্রত দাস বলেন, ভাসমান বেডে উৎপাদিত ফসল রাসায়নিকমুক্ত ও বিষমুক্ত হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা বেশি। প্রতিটি ধাপে ১ হাজার ২ শ টাকা ব্যয় হলেও ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকার ফসল বিক্রি করা যায়। বানিয়াচং উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ দুলাল উদ্দিন জানান, ভাসমান বেডে সবজি চাষ লাভজনক। এলাকার কৃষকদের এ ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে চাষীরা ভাসমান বেডে সবজি চাষ করতে রাজি হন। এ বছর সবজি বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে অন্য কৃষকদের মধ্যেও আগ্রহ দেখা দিয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ তমিজ উদ্দিন খান জানান, ভাসমান বেডে সবজি আবাদ সম্প্রসারণ এবং জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ মাঠে কাজ করছে। এটি একটি লাভজনক পদ্ধতি। কৃষকরা এখান থেকে লাভবান হতে পারছে। তাছাড়া হাওর এলাকায় সবজির চাহিদাও পূরণ হবে। বাকীগুলো বিক্রি করে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট এর অর্থায়নে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।


     এই বিভাগের আরো খবর