,

খোলা চিঠি: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহোদয়া সমীপেষু

আমার সালাম ও শ্রদ্ধা জানিবেন। অদ্য আপনাকে উদ্দেশ্য করে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলতে চাই। যাহা আমাদের দেশ ও জাতীয় রাজনীতির সাথে সম্পর্ক রয়েছে। প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যে, গত ১৫ই নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের একটি সার্কুলারে জানানো হয়েছে এখন থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও অবদান চিরস্থায়ী করে রাখার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহীদদের নামে রাস্তাঘাট ও স্থাপনা করা হবে। ইতোমধ্যেই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসকদের এ আদেশ দেয়া হয়েছে। এই সার্কুলারে অনুযায়ী কাজ না করলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই সার্কুলারে আমি ও আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে স্থায়ী কিছু করার জন্য (তাদের নামে নামকরন ব্যাপারে) সর্বদা আপনাকে অনুরোধ করে আসছিলাম। আমরা এই সিদ্ধান্তে খুবই খুশি হয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন ও মর্যাদার প্রশ্নে অনেক অনেক লেখালেখি ও গবেষণা করে গেছি। কিন্তুু কোনদিন নিজের এবং পরিবারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অবদানের জন্য কোন কিছু পাওয়ার আবদার করেনি। কিন্তুু আপনার সরকারের এই সার্কুলার প্রকাশিত হওয়ায় দায়ীত্ববোধ থেকে পরিবারের একজন সদস্যের জন্য আজ একটি দাবী তুলে ধরতে চাই। আমার চাচা সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল মামুন পাকিস্তান আমলে সিলেটের লাক্কাতুয়া চা বাগানে চাকুরী করতেন। চা বাগানগুলোতে পাঞ্চাবী ম্যানাজারদের অত্যাচার ও নির্যাতনে বাঙ্গালীরা অতিষ্ট ছিলেন। ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারতেন না। আমার চাচা সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল মামুন সব সময়ই প্রতিবাদী ছিলেন। তিনি পাকিস্তানী হানাদারদের ভয় করতেন না। তিনি আগাগোড়া পাক বিরোধী ছিলেন। আমার চাচা ১৯৭০ সালে সম্ভবত আগষ্ট মাসে আমাদের হবিগঞ্জের বাসায় বেড়াতে আসেন। সেখানেই আমার চাচার সাথে আলাপ হয়। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ভাতিজা শুনলাম তুমি নাকি পলিটিক্্র কর? আমি বললাম, জি¦ হ্যা। তখন আমি ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমার বিভিন্ন লেখায় ছাত্র রাজনীতির সম্পৃক্ততা বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছি। আমার চাচা আলোচনার মধ্যে আমাকে বললেন, পাকিস্তানীরা আমাদের দেশটাকে লুঠেপুটে খাচ্ছে। দেশের মানুষের উপর অমানুষিক অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছে। দেশের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। তাই তোমরা ছাত্ররা দেশের জন্য লড়াই করার প্রত্যয় গ্রহণ কর। হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াও। আমি সেদিন চাচার চোখেমুখে হানাদারদের বিরুদ্ধে আগুন দেখেছিলাম। পাশেই আমার বাবা উপস্থিত ছিলেন। তখন আমার পিতা আমাকে বললেন, তোমার চাচা পাকিস্তানীদের সাথে কাজ করার সুবাদে পাক হারামীদের ভাল করে চিনেন জানেন। পাকিস্তানীরা তোমার চাচাকে হিংসা করতো এবং বিভিন্নভাবে অত্যাচার নির্যাতন করতো। তার স্বাক্ষী আমি নিজে। এই বলে আমার পিতা উনার ডান হাত বের করে দেখালেন। হাতের দুটি আঙ্গুল কর্তন করা। আমরা জানতাম দুটি আঙ্গুল দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন। কিন্তুু বাবা বললেন, ইহা দুর্ঘটনা নয়। ১৯৬৫ সাল থেকে আমার বাবা ইংল্যান্ডে প্রবাসী ছিলেন। সেখানে একটি কারখানায় কাজ করতেন। সেই কারখানায় পাকিস্থানীদের অধিপথ্য ছিল। পাকিস্তানীরা বাবাকে বিভিন্নভাবে অন্যায় অত্যাচার করতো শুধু মাত্র বাঙ্গালী বলে। আমার বাবা কাজে দক্ষ ছিলেন বিধায় পাকিস্তানীরা খুব বেশী হিংসা করতো। বাবা বললেন, “একদিন আমি কারখানায় মেশিন বন্ধ করে সেই মেশিন পরিস্কার করছিলাম। আমার সহকর্মী পাকিস্তানীরা শুধুমাত্র হিংসা ভরে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিস্কার করা অবস্থায় মেশিন চালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ডান হাত মেশিনে চলে গেল। অনেক কষ্টে হাত বাঁচাতে পারলেও আঙ্গুল দুটি কেটে যায়। মামলা করেছিলাম কিন্তুু আমার সহকর্মীরা পাকিদের ভয়ে স্বাক্ষী দিতে আসলনা। বৃটিশ ট্রেড ইউনিয়ন সঠিক পদক্ষেপ নেয়ায় সেদিন মামলায় ক্ষতিপুরণ পেয়েছিলাম। এভাবেই পাকিস্তানীরা আমাদের উপর বহুবার অন্যায় অত্যাচার করেছিল”। ১৯৭১ সালে আমার চাচা যুদ্ধ চলাকালীন দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনসহ বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করেছিলেন। এমতাবস্থায় পাক বিরোধী কাজে সম্পৃক্ত থাকায় আমার চাচাকে পাক হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তুু সেই সময় পাঞ্চাবী এক বাগান ম্যানেজার পাক বাহিনীর মেজরের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে মেজরকে বলল, “মামুন যদি পাক বিরোধী হয় তাহলে তার বিচার করো, কিন্তুু বিনা বিচারে হত্যা করতে দিবনা”। এই বলে সে মেজরের সাথে চাচাকে নিয়ে সিলেট জেলে রেখে ফেরার পথে বাঙ্গালীদের হাতে নিহত হন। পরবর্তীতে পাক সেনারা আমার চাচাকে হত্যা করেছিল। দেশের জন্য আমার চাচার আত্মদান বৃথা হতে পারেনা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ১৯৭৫ সালের পর লন্ডনে আমার ছোট বোন দেওয়ান ফরিদা হোসেনের বাসায় আমার মরহুম মাতার সাথে আাপনার ছোট বোন শেখ রেহেনা আপা সহ অন্যান্য সদস্যদের স্বাক্ষাত হয়। আমার মাতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আপনার বোনসহ সকলকে পরম মমতায় সাদরে গ্রহন করেছিলেন। আমার মাতা আমাকে বললেন, “বাবা, নির্দোষ নিরপরাধ বঙ্গবন্ধুকে যারা নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে তাদেরকে খুজে বের করে ফাঁসির ব্যবস্থা করতে পার না? যে বঙ্গবন্ধু না হলে এদেশের স্বাধীনতার জন্ম হতনা সে মহান ব্যক্তির হত্যার প্রতিশোধ না নিলে আমার মনে শান্তি আসবে না”। আমি উত্তরে বলেছিলাম, “আম্মা আমাদের বঙ্গবন্ধুর পক্ষের লোকগুলি বেশীর ভাগই স্বার্থপর এবং নিজের ভাল ছাড়া বুঝতে চায়না। সেজন্য অনেক কিছু করতে চাইলে ও করতে পারিনা। কিন্তুুু আমি থেমে থাকবনা। আমি আমৃত্য দেশের কল্যানে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে সংগ্রাম করে যাব”। আমার এহেন বক্তব্য শুনে আমার মাতা খুশি হলেন। মাতৃভূমির জন্য কিছু করার স্বার্থে বিশ^াস ঘাতকদের খুজে বের করার চেষ্টা করত: বিভিন্নভাবে গবেষণালব্দ তথ্যগুলি জিয়াউর রহমান ও এরশাদের কঠিন সময়ে “বাংলাদেশের জেনারেলদের ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতি” নামক তথ্য উপাথ্য সমন্বয়ে একটি বই লিখি। সেজন্য আমি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আজকাল বিভিন্ন টকশো বা লেখালেখিতে আমার উল্লেখ করা বিষয়গুলো জানা অজানা তথ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষের লোক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। যা হোক বঙ্গবন্ধুর হত্যার ঘটনায় জেনারেল জিয়াউর রহমান নাটের গুরু হিসেবে জড়িত রয়েছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। খালেদ মোশারফ, কর্ণেল হুদা, কর্ণেল হায়দার সাহেবদের সাথে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছি। মেজর জেনারেল মুনজুরসহ নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার বিবরণ দিয়েছি। কর্ণেল নুরকে আমরা লন্ডনে আটক করতে চেয়েছিলাম। কিন্তুু কিছু স্বার্থপর সেনা কর্মকর্তার ইচ্ছাকৃত ভাবে সয়তানীর জন্য লন্ডন থেকে নুর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। শুধু কর্ণেল নুরই নয়, মেজর ডালিম, কর্ণেল রশিদসহ এদের বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট রয়েছে। নাম পরিবর্তন করে ভারতে লুকিয়ে থাকা ক্যাপ্টেন মাজেদ ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে বহাল তবিয়তে কলকাতায় মাষ্টার সাহেব সেজে বসবাস করছিলেন। এরপর ঢাকায় ধরা পরে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলেন। জেনারেল জিয়ার বিভিন্ন ইতরামী ও তারেকের দুষ্ট কার্যক্রমে আপনাকে হত্যার জন্য কুখ্যাত ২১ আগষ্টের ঘটনায় আমরা মর্মাহত হয়েছিলাম। কর্ণেল নুর আমাদের হবিগঞ্জের একজন প্রবাসীর পরিচয়ে টাকা পেয়ে আপনার উপর গ্রেনেড হামলার নেতৃত্ব দেয়। ঘটনার সত্যতার জন্য যদিও ঐ প্রবাসী এখন আর বেঁচে নেই কিন্তুু তার স্ত্রী মিনারা বেগম এখনও জীবিত আছেন। ঐ প্রবাসীর নাম এখলাস মিয়া, বাড়ী নবীগঞ্জ থানার কান্দিগাও গ্রামে। কর্ণেল নুর তার নামের সাথে চৌধুরী যোগ করে হয়ে যায় এখলাস মিয়া চৌধুরী।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাকে কিছু সত্য ঘটনা তুরে ধরতে চাই। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষনার পর যেসব ব্যক্তিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেছিলেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করতে শুরু করেছিলেন এদেরকে পাকিস্তানীদের পক্ষে ফিরিয়ে আনার নানাভাবে প্রতারনার আশ্রয় নেয় কিছু পথভ্রষ্ট বাঙ্গালী সেনাসদস্য। আমার মিসেসের চাচাতো ভাই উইং কমান্ডার (১১নং সেক্টর) হামিদুল্লাহ খান ২৬ মার্চ এর পর ঢাকা ত্যাগ করে আগরতলায় অন্যান্য সামরিক বাঙ্গালী অফিসারদের সাথে যোগ দেন। এপ্রিল মাসে তিনি চব্বিশ পরগনায়র একটি গোপন স্থানে ভারতীয় বাহিনীর অতি গোপন নিরাপত্তা বাহিনীর তত্তাবধানে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ লড়াই পরিচালনার জন্য একটি চৌকশ লড়াকু দল গঠন করেন। ভারতে সুরক্ষিত স্থানে ট্রেনিং অবস্থায় আমার মিসেসের চাচাতো ভাই জনাব হামিদুল্লাহ খান সাহেবের শশুরের হাতের লেখা একটি চিঠি পান। চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী তিনির শশুর এবং আমার সমন্ধীর স্ত্রীকে পাকবাহিনী ধরে ঢাকা ক্যান্টেনম্যান্টে নিয়ে যায়। পরে আমার মিসেসের ভাবী মিসেস হামিদুল্লাহ খান রেখা ও তার পিতা ফিরে আসেন এবং নিরব থাকে। হামিদুল্লাহ খানকে ফিরে আসতে স্বাধীনতা বিরোধীরা কোটকৌশলে তিনির শশুরকে দিয়ে চিঠির মারফত লোভের টোপ ফেলে একটি ভয়ঙ্কর ফাঁদ তৈরী করে। পাক বাহিনীর দোসর পথভ্রষ্ট কিছু বাঙ্গালী সেনা অফিসার তাদের সাথে চালাকি করে লড়াকুদের তাদের আয়ত্বে নিয়ে মুক্তি বাহিনীর ভিতরের খবর নিয়ে ও পরবর্তীতে মেরে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টায় ছিল। সোজা কথা ধোকা দিয়ে মেরা ফেলা। কিন্তুু হামিদুল্লাহ খান ট্রেনিংপ্রাপ্ত চৌকশ সেনা অফিসার হওয়ায় এই ফাঁদে তিনি পা দেননি। পরিতাপের বিষয় হলো আমার চাচা একটু সরল টাইপের হওয়ায় ভারতে ট্রেনিং অবস্থায় এক নাম না জানা পাকিস্তানী গুপ্তচর বাঙ্গালী সেনা অফিসারের প্রতারনার ফাঁদে পা দিয়ে উনার শশুর বাড়ি পাল্লাকান্দিতে ফিরে আসলে ঐ ব্যক্তি আমার চাচাকে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। পরবর্তীতে আমার চাচাকে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা হরে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যে সেনা অফিসার চাচাসহ তাহার পরিবার পরিজনকে ধোকা দিয়ে চাচাকে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই বিশ^াস ঘাতককে (যদি বেঁচে থাকে) ধরে চিহ্নিত করে ফাঁসি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। আমার অসহায় চাচার স্ত্রী পুত্র কন্যাদের মর্যাদার সাথে সম্মানীত করার অনুরোধ জানাই। অনতিলম্বে হবিগঞ্জের মাটিতে একটি স্মৃতি স্তম্ভ্য স্থাপনা করাসহ চাচাকে স্বাধীনতা পুরষ্কার দেওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি এবং হবিগঞ্জের একটি রাস্তা আমার চাচার নামে নামকরন করার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কিছু সত্য কথা বলতে গিয়ে পারিবারিক ও ব্যাক্তিগত ঘটনা উল্লেখ করায় যদি সীমা লঙ্ঘন করে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। হাজারও বিপদে আপদের মুখে আল্লাহ সোবহানু তায়ালা আপনাকে হেফাজত করুন এই দোয়া করি।

 

 

বিনীত
দেওয়ান কাইউম
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক
যুক্তরাজ্য।


     এই বিভাগের আরো খবর