,

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন না মোস্তফা মিয়া

রাকিল হোসেন ॥ ১৯৪৬ সালে মৌলভীবাজার জেলার সাধুহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ মোস্তফা মিয়া। তাঁর বাবার নাম কুদরত উল্লা এবং মায়ের নাম বারজান বিবি। একটি মাদরাসায় পড়াশোনা করতেন মোস্তফা মিয়া। পাশাপাশি একটি মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব ছিলো তাঁর। এ সময় এলো যুদ্ধের ডাক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি যুদ্ধে অংশ নিয়ে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন।
১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর তিনি শত্রুবাহিনীর সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারান। তারপর তাকে সুনামগঞ্জের ঐতিহাসিক ডলুরা স্মৃতিসৌধে সমাহিত করা হয়। কিন্তু দু:খের বিষয়, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও এই বীর যোদ্ধার নাম নবীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় স্থান পেলো না। মোস্তফা মিয়ার স্ত্রী আয়াতুন বিবি ও একমাত্র ছেলে শাহজাহান মিয়া এখনো জীবিত। স্ত্রী আয়াতুন বিবি’র একটাই আকুতি, ‘মরে যাবার আগে যেন স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখে যেতে পারি।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিলো। সেই ১১ সেক্টরের উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনের ৫নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত ছিলো বালাট সাব-সেক্টর। সেই সাব-সেক্টরের একটি গ্রাম ডলুরা। ভারতের বালাট সীমান্তের শেষ মাথায় নোম্যান্স ল্যান্ডের পর থেকে যেখানে বাংলাদেশের শুরু সেই গ্রামটির নাম ডলুরা। সুনামগঞ্জের ঐতিহাসিক ডলুরা স্মৃতিসৌধে ৪৮ জন শহীদের মধ্যে ২০ নম্বর স্মারকটি শহীদ মোস্তফা মিয়ার। মুক্তিযোদ্ধা মধু মিয়ার কল্যাণে সেই স্মৃতিসৌধ সৃষ্টি হয়। মধু মিয়ার হাতে গড়া স্মৃতিসৌধে মন্তাজ মিয়ার ঠাঁই হলেও মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় তাঁর ঠাই হয়নি। ডলুরা স্মৃতিসৌধে যারা সমাহিত হয়েছেন তাদের সবার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সম্মানের সাথে স্থান পেলেও মোস্তফা মিয়ার ভাগ্যে সেই সম্মানটুকু জুটেনি।
স্ত্রী বলেন, ‘একদিকে যুদ্ধে যাবার জন্য বঙ্গবন্ধুর আহবান, অন্যদিকে মায়ার সংসার। কিন্তু দেশপ্রেমের টানে পরিবারের মায়া ত্যাগ করে, স্ত্রী, সন্তান, মা বাবাকে ফেলে তিনি চলে গেলেন যুদ্ধে। যুদ্ধের ময়দানে জীবন দিলেন। যার ফলে একটি দেশ স্বাধীন হলো, আর পেছনে পড়ে রইলো একটি অসহায় পরিবার। আমার সন্তান বাবাহারা হলো দেশের জন্য। কিন্তু দেশ আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি। এটি বড় কষ্টের। এই কষ্ট বলে শেষ করা যাবেনা।’
শীতের কোনো এক ভোরে মধু মিয়ার ডায়রীতে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী রওয়ানা দেই মৌলভীবাজারের সাধুহাটা গ্রামে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, পরিবারটিকে মুক্তিযুদ্ধের পরে সাধুহাটি থেকে তাড়িয়ে দেয় স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার। তারপর তাদের আশ্রয় হয় শহীদ মোস্তফা মিয়ার শ্বশুরবাড়ি নবীগঞ্জের মনেরসুখ ইছাপুর গ্রামে। সেখানে যাবার পর দেখা হয় পরিবারের সাথে। মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মিয়ার একমাত্র ছেলে শাহজাহান মিয়া বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করছেন। মোস্তফা মিয়ার বোন ছবুতেরা বিবি এখনো জীবিত। ভাইয়ের স্মৃতিরোমন্থন করতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন তিনি। চোখের জল মুছে বললেন, ‘আমার স্বামী ওয়াছিদ আলীও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন এবং তাকে ডলুরায় কবর দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার স্বামী এবং আমার ছোট ভাই মোস্তফা একসাথে যুদ্ধে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হন। সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারিনি।
মোস্তফা খুব শান্ত স্বভাবের ছিলো। একদিন হঠাৎ এসে যুদ্ধে যাবার কথা বলে। আমার মা যখনি শুনলেন যুদ্ধে যাচ্ছে, দেশকে স্বাধীন করার জন্য, তখন তিনি আর বাধা দিলেন না। যেদিন যুদ্ধে যায়, সেদিন আমার মা সারারাত ঘুমাতে পারেননি। এভাবে বহুরাত তিনি নির্ঘুম ছিলেন। বহুরাত কেঁদেছেন। তারপর ভাইটির আশায় আশায় মা মরে গেলেন। যুদ্ধে যাওয়া কলিজার ধনকে দেখে মরতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হবার পর অনেকে বাড়িতে ফিরে আসে, আমার ভাই আসেনি। তারপর ভাইয়ের পরিবারটির খবর কেউ নেয়নি। এমন কি সরকারও না। আমার ভাই এখনো মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় স্থান পেলোনা। আমাদের কান্নার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেলে সব। আমরা কিছু চাইনা, শুধু ভাইটির নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় দেখে যেতে চাই।’
শহীদ মোস্তফা মিয়ার একমাত্র ছেলে শাহজাহান মিয়ার স্ত্রী লাকি বেগম জানান, ‘বছরের পর বছর আমরা একবুক আশা নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। নবীগঞ্জ থেকে ঢাকায় ছুটাছুটি করছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবো। জানিনা এর শেষ কোথায়।’
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হয় নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর ছাতাইহাল গ্রামের বাসিন্দা ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক নূর উদ্দিন আহমেদের সাথে। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন জানিয়ে বলেন, ‘আমরা খুব চেষ্টা করেছি। এখনো চেষ্টা চলছে। এটি আমাদেরকেও মর্মাহত করে।’
যোগাযোগ করা হলে উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার সুমাইয়া মোমিন জানান, ‘আমি কয়েকদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছি তাই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে আমি দেখবো।’


     এই বিভাগের আরো খবর