,

মিহির কুমার রায় স্মরণে –রতœœদীপ দাস রাজু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এককালের প্রতিথযশা শিক্ষক অধ্যাপক ড.জি.সি দেব বলতেন-‘পৃথিবীতে লোক সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।’ আজকের নীতি বিবর্জিত সমাজ ব্যবস্থায় মিহির কুমার রায়ের কথা ভাবলে মনে হয় তিনি একজন সত্যিকারের মানুষ ছিলেন, যিনি জীবনাচারে ছিলেন নম্র, সজ্জন ও সমাজ হিতৈষী। একজন সফল সংগঠক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফোরামে। সমাজের একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে অনেক বিপন্নগামীকে দেখিয়েছেন সত্য ও ন্যায়ের পথ। সমাজের এই আলোকিত মানুষটির শ্রাদ্ধ্যানুষ্ঠানে তাঁর স্মরণে আজকের আমার এই প্রয়াস। মিহির কুমার রায় মিন্টু বাবু ব্রিটিশ ভারতের সিলেট জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার কালিয়ারভাঙ্গা গ্রামে ১৯৪২ সালের ১৪ই জানুয়ারী জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহেশ চন্দ্র রায় ও মাতা সরোজ নলিনী রায়। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। তিনি নবীগঞ্জ জে.কে, উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাস, হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে আই.এ এবং বি.এ পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েটে অধ্যয়নরত অবস্থায় রীনা রায় এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পড়াশুনা শেষ করে নবীগঞ্জ জে.কে. উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি কিছুকাল শিক্ষকতা করেন ও পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব হিসাবে কর্মজীবন শেষ করেন। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তিনি নবীগঞ্জে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য কাজ শুরু করেন। তখন তিনি নবীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন কাউন্সিলের সচিব। আর সেই দায়িত্বকে কাজে লাগিয়ে তিনি নবীগঞ্জের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ভূমিকা রাখেন। একটা সময় ভারতের অভ্যন্তরে চলে গেলে শ্রীনাথপুর, কৈলাশহর সহ বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্পে ক্যাম্প পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। স্বাধীনতার পর নবীগঞ্জ ফিরে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমের পাশাপাশি রেডক্রিসেন্ট এর কার্যক্রমে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ব্যক্তিগতভাবেও গৃহহীন, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ান। মিন্টু বাবু নবীগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বস্ত নেতা ছিলেন। যিনি তার সততা, মেধা, মনন ও দক্ষতা দ্বারা দল ও এলাকার জন্য নিভৃতে ও নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত নবীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী চেয়ারম্যান, নবীগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা দপ্তর সম্পাদক ও বিভিন্ন সময় দলের থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতি ও পৌর কমিটির সভাপতি এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত উপদেষ্ঠা হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাছাড়াও হবিগঞ্জ-১ আসনের তিনটি নির্বাচনে প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব অত্যন্ত সততা ও দক্ষতার সাথে পালন করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনের সমান্তরালে সামাজিক মঞ্চেও ছিলেন জনপ্রিয়। নবীগঞ্জের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে তাঁর উপস্থিতি তথা অংশগ্রহণ সকল পর্যায়ের মানুষের কাছে ছিল গ্রহণযোগ্য। এলাকার শালিস বৈঠকে তার ভূমিকা ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে ছিল আবশ্যিক। এছাড়া বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ নবীগঞ্জ উপজেলা শাখার সংগঠনদ্বয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে অনেক মানবিক কাজ করে গেছেন। তাঁর গতিশীল সাংগঠনিক দক্ষতা দ্বারা তিনি নবীগঞ্জ উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদকে বৃহদাকৃত সংগঠনে রূপান্তরিত করেন। নবীগঞ্জের কেন্দ্রীয় আখড়া “গবিন্দ জিউর আখড়া” পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন সংস্থার সাথে জড়িত ছিলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে কয়েকদিন গুরুতর অসুস্থ থাকার পর বিগত ০৯ই নভেম্বর ২০১৫ইং তারিখে ৭৯ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে নবীগঞ্জের রাজনৈতিক, সামাজিক অঙ্গনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, যা অপূরনীয়। তিনি ছিলেন সবার প্রিয়, পূজনীয়, বিশ্বস্থ এবং ধর্ম-দল-মত নির্বিশেষে একজন অভিভাবকতুল্য ব্যক্তিত্ব। তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে অনুপস্থিত হলেও তার কর্ম ও সৃষ্টি শীলতার মাঝে তিনি জাগরূক হয়ে রইবেন। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনাই হোক আজ আমাদের প্রার্থনা।
লেখক ঃ সদস্য সচিব, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, নবীগঞ্জ উপজেলা শাখা।


     এই বিভাগের আরো খবর