,

দখলদারদের কবলে খোয়াই নদী বিপন্ন পরিবেশ ॥ হুমকির মুখে হবিগঞ্জ

আব্দুল হামিদ ॥ হবিগঞ্জ শহরের বুক চিড়ে বয়ে চলা খোয়াই নদীটিই হবিগঞ্জের প্রাণ। নানা কারণে নদীটি দখল করে বানানো হয়েছে ময়লা আবর্জনার ভাগার। এ অবস্থায় প্রথম শ্রেণির পৌর শহর হবিগঞ্জকে বাঁচাতে হলে অপদখলমুক্ত করে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দিতে হবে খোয়াই নদীকে। সিলেট অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান শহর হবিগঞ্জে বসবাস করেন লক্ষাধিক মানুষ। পুরাতন খোয়াই নদী, খাল, জলাশয় ইত্যাদি দখল করে অপরিকল্পিতভাবে দালানকোঠা ও স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত থাকায় এ দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। ১৯৭৮-৭৯ সালে হবিগঞ্জের দুঃখ হিসেবে পরিচিত খোয়াই নদীকে শহর থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার বাইরে নেয়া হয় স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে। এরপর থেকে পুরনো খোয়াইয়ের দুই পাড় দখলদারদের দৃষ্টি পড়ে। শুধু দখলদারই নয়, সরকারিভাবেও গড়ে উঠে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শহরের মাছুলিয়া থেকে হরিপুর পর্যন্ত পুরাতন খোয়াই নদীর দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার। আর অবৈধ দখলদারের সংখ্যা ৫ শতাধিক। দখলদারের অবৈধ দখল করা জমির পরিমাণ প্রায় ২ একর। দুই বছর আগেও যে পুরাতন খোয়াই নদীতে পানি ছিল সেখানে এখনকার চিত্র দেখলে মনে হবে কোনো সময় ওই জায়গায় নদীর কোন চিহ্ন ছিল না। খোয়াই নদী দখল করে অট্টালিকা তৈরি করছেন এমন সব লোক, যারা সমাজে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। অবৈধ দখলদারদের তালিকায় আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ডাক্তার, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীসহ জনপ্রতিনিধিরা। এরা আগে রাতের আঁধারে নদী ভরাট করে জায়গা দখল করতেন। এখন তারা দিনে দুপুরে নদী দখল করে ঘর নির্মাণ করছেন। প্রতি মাসেই জেলা আইনশৃংখলা সভায় অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে আলোচনা হয়। ব্যাপক তোড়জোড় নিয়ে প্রশাসন মাঠেও নামে। কিন্তু অদৃশ্য সুতোর টানে তা কিছুদিন পড়েই স্থিমিত হয়ে পড়ে। বাপা ও পুরাতন খোয়াই নদীরা কমিটির উদ্যোগে পুরাতন খোয়াই নদী দখলমুক্ত সীমানা চিহ্নিতকরণ ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণের দাবিতে গণসমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করে। ওই গণসমাবেশ ও মানববন্ধনে বাপার সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এডভোকেটসহ শহরের কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। জেলা প্রশাসন দখল হওয়া খোয়াই নদী পুনরুদ্ধারে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে। জনমনে প্রত্যাশা জাগে এবার নদী দখলমুক্ত হবে। কিছুদিন চেইন ফিতা নিয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। মানববন্ধনের পর প্রশাসনের উদ্যোগে একটা কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির মাধ্যমে পরবর্তীকালে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত পুরাতন খোয়াই নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এই জলাধার সংরণ প্রকল্পের এস্টিমেট পাঠানো হয়। এছাড়া পুরাতন খোয়াই নদীর বাকি অংশ সংরক্ষণের জন্য লোকাল গভর্নমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও পৌরসভার সমন্বয়ে কাজ করার কথা থাকলেও। জেলা পরিষদের সামনে ও শহরের মাহমুদাবাদের পশ্চিম ও শায়েস্থানগর এলাকার পুর্ব দিক, মুসলিম কোয়ার্টার- নিউ মুসলিম কোয়ার্টার, সিনেমা হল, উত্তর শ্যামলী এলাকায় পুরাতন খোয়াই নদীতে দীর্ঘদিন ধরে ময়লা, আবর্জনা ফেলে দখল করে বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। কতিপয় লোক পৌরসভার ভ্যান চালকদের বশ করে এখানে দিনের পর দিন ময়লা ফেলছে। এমনকি নিজেরা দিনমজুর দিয়ে বাজার এলাকার সব ময়লা ফেলে যে যার মতো করে দখলে নিচ্ছে। ফলে ময়লার গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নদীর পানি। এমতাবস্থায় নদীর পানি ব্যবহারকারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। বিভিন্ন স্থানে নদীর গতিপথ সরু হয়ে তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। ফলে সার্বিক পরিবেশ শুধু বিপন্নই হয়নি, জেলা শহর মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এছাড়াও সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং অসচেতনতার জন্য নদীনির্ভর জীবনযাত্রাকেও বিপন্ন করছে। কোথাও কোথাও শহর থেকে ৮/১০ ফুট উঁচুতে উঠে গেছে নদীর তলদেশ। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শহর রক্ষার জন্য ৭০-এর দশকের শেষে মাছুলিয়া-রামপুর ও খোয়াই মুখ-গরুর বাজার পর্যন্ত দুই দফায় ৫ কিলোমিটার লুপ কাটিংয়ের মাধ্যমে খোয়াই নদীর গতি পরিবর্তন করে শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত করে দেয়া হয়। ফলে শহরের মাঝ অংশ দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা খোয়াই হয়ে যায় পুরনো খোয়াই নদী। নদীর এ ৫ কিলোমিটার অংশ লুপ কাটিং করার আগে নদীর প্রস্থ ছিল স্থান ভেদে ২শ ৫০ থেকে ৩শ ফুট এবং গভীরতা ছিল ২৫ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত। নদী শাসনের পর দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে পুরাতন খোয়াই নদীর অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে পুরাতন খোয়াই নদী শহরের সর্ববৃহৎ ডাস্টবিনে রূপ নিয়েছে। নদীর আশপাশের বাসাবাড়ির পয়ঃনিষ্কাশন, ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে।


     এই বিভাগের আরো খবর