,

নবীগঞ্জে কলেজ ছাত্রী তন্নী হত্যা মামলা—প্রেমিক রানু’র বাসায় তল্লাশী চালিয়ে বিভিন্ন আলামত উদ্ধার : সন্দেহ ভাজনদের গ্রেফতারে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের অভিযান- রানুর সাথে তন্নীর মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে ৪ শতবার

মতিউর রহমান মুন্না/জসিম তালুকদার ॥ নবীগঞ্জের চাঞ্চল্যকর কলেজ ছাত্রী তন্নী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করতে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে নবীগঞ্জে তোলপাড় চলছে। হত্যার নেপথ্যে ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী কিনা এনিয়েও থেমে নেই বিতর্ক। বর্তমান অবস্থায় তদন্তে ও বিভিন্ন আলামত সংগ্রহে প্রাথমিকভাবে অনেকেই ধারনা করছেন রানু রায়ই মূল হত্যাকারী। পুলিশ ও স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, গতকাল শুক্রবার সকাল ১১টায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নবীগঞ্জ থানার এস আই মোবারক হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর ও দৈনিক হবিগঞ্জ সময় পত্রিকার সম্পাদক মোঃ আলাউদ্দিন ও পৌর কাউন্সিলর জায়েদ চৌধুরীসহ স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতিতে প্রেমিক রানু রায়ের বাসার তালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেন। এসময় বাসায় তল্লাশী চালিয়ে কিছু ডিস লাইনের তার, ছটের খালি বস্তা এবং ঘরের সন্দেহজনক একটি তোষক আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত বস্তা ও ডিস লাইনের তারের সাথে মৃত তন্নীর হাত পায়ে বাধা তার ও বস্তার মিল রয়েছে। জব্দকৃত সরঞ্জামাধি রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হবে বলে জানা গেছে। কিন্তু নিখোঁজের ৭ দিন ও লাশ উদ্ধারের ৪ দিন অতিবাহিত হলেও হত্যাকান্ডে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। যদিও হন্য হয়ে খুজেঁও কোন সন্ধান মিলছে হত্যাকারীদের, এমন দাবী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার। কারন ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছে তার প্রেমিক রানু রায়। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ২টি বন্ধ, কিন্তু তার কল লিষ্ট সংগ্রহ করে তদন্ত হচ্ছে। রানুর সাথে তন্নীর এয়ারটেল টু এয়ারটেল সিম দিয়ে ৪ শত বার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। সর্বশেষ ১৭ তারিখ দুপুর ১টার সময় রানু তন্নীকে কল দেয়, অনেক সময় আলাপও হয় তাদের। রানু রায় গ্রেফতার হলে হত্যার সাথে কারা কারা জড়িত তার মূল রহস্য উদঘাটন হবে বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের লোকজন। এদিকে লাশের বস্তায় মোড়ানো ছিল ডিস লাইনের তার। এএসকে কোম্পানির ওই তারের অবশিষ্ট অংশ রানু ঘর থেকে উদ্ধার করার পর হুবুহু মিল পাওয়া গেছে। প্রাথমিক ভাবে প্রমানিত রানুর ঘরে থাকা এই তার হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও রানুর পিতা একজন সবজি বিক্রেতা। একটি সবজির (আলুর) বস্তার ভিতরে তন্নীর লাশ ছিল। লাশের বস্তা ও রানুর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা বস্তারও হুবুহু মিল রয়েছে। এতে প্রাথমিকভাবে প্রমান হয় রানু হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। গত বৃহস্পতিবারে পুলিশ তন্নীর লাশের সাথে বস্তায় ব্যবহৃত ছামিন কোং ইট জয়নগর এলাকায় সৈয়দ জাহির মিয়ার বাড়ির নির্মাণ কাজের ব্যবহার কালে জব্দ করেছে। নির্মম এ হত্যাকান্ড নিয়ে এখনো আলোচনার রেশ কাটেনি। লোকমুখে নানা জল্পনা কল্পনা রয়েছে। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা নং ২২ তাং-২১/০৯/২০১৬ইং দায়ের করেন নিহতের পিতা বিমল রায়। ঘটনার পর পরই পুলিশ এই লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন এবং জড়িতদের গ্রেফতারে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে হানা দিয়েও তন্নীর প্রেমিক রানু রায় ও পরিবারের কোন সদস্যকে না পাওয়ায় গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মোবারক হোসেন। পুলিশ এ পর্যন্ত তন্নীর ঘনিষ্ট বান্ধবী কান্তা রায়, নবীগঞ্জ ইউ.কে আইসিটি ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল ফয়সল আহমদ চৌধুরী ও প্রশিক্ষক নাজনীন আক্তার এবং রানু রায়ের খালাতো ভাই ও ঘনিষ্ট বন্ধু রিংকু রায়’কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কান্তা রায় তন্নীর ঘনিষ্ট বান্ধবী ও পাশের বাসার কাজল রায়ের মেয়ে। নবীগঞ্জ ইউ.কে আইসিটি ইন্সটিটিউট প্রশিক্ষক নাজনীন আক্তার কুর্শি ইউপির বাজকাশারা গ্রামের আব্দুর রহিমের মেয়ে। সে দীর্ঘদিন ওই ইন্সটিটিউটে ট্রেইনার হিসেবে কর্মরত। সেই সুবাধে তন্নীর সাথে তার ঘনিষ্টতা ছিলো। রিংকু রায় শিবপাশা এলাকার রথী রায়ের ছেলে এবং তন্নীর প্রেমিক রানু রায়ের খালাতো ভাই। স্থানীয় লোকদের অভিমত তন্নী’র বান্ধবীদের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। সুত্রে জানাযায়, তন্নী রায়ের পিতা বিমল রায়ের বাসায় ভাড়াটে থাকতেন রানু রায় ও তার পরিবার। সেই সুবাধেই একে অপরের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রায় মাস দেড়েক পুর্বে জয়নগর এলাকায় নতুন বাড়ি করে রানু রায় ও তার পিতা কানু রায় বিমল রায়ের বাসা ছাড়েন। কললিষ্ট সুত্রে জানা যায়, কলেজ ছাত্রী তন্নী নিখোজের আগের দিন অথাৎ ১৬ই সেপ্টেম্বর রাতে রানু রায় তন্নীর সাথে প্রায় ৪৫ মিনিটেরও বেশী সময় কথা বলেন। সর্বশেষ তন্নীর মোবাইল নম্বারে প্রেমিক রানু রায় ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুর ১.১৩ মিনিটে ফোন দিয়ে কথা বলে। আর তন্নী ওই দিনই দুপুর দেড়টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে নবীগঞ্জ ইউ.কে আইসিটি ইন্সটিটিউটে যাওয়ার কথা বলে আর ফিরে আসেনি। তবে নবীগঞ্জ ইউ.কে আইসিটি ইন্সটিটিউট অধ্যক্ষ ফয়সল তন্নী ক্লাশে আসেনি বলে তার পিতাকে জানান। ফয়সলের সাথে আলাপকালে শতবাগ নিশ্চিত করে বলেন তন্নী ওই দিন ক্লাসে আসেনি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর শনিবার তন্নী ক্লাশ করতে না যাওয়ার কথা জানালেও এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রতিষ্ঠানের পার্শ্ববর্তী এক্সিম ব্যাংকের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করার পাশাপাশি অন্যভাবে যাচাই করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতন মহল। এছাড়া তন্নীর ঘনিষ্ট বান্ধবী কান্তা রায়ের ভাষ্য মতে প্রেমিক রানু রায় তন্নীর অন্য কারো সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন সন্দেহ করে আসছিল। যা হয়তো স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেনি প্রেমিক রানু। ধারনা করা যাচ্ছে, এসব কারনেই রানু রায় তন্নী রায়কে ফোনে ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে ডেকে আনে এবং তন্নী’কে তার নিয়ন্ত্রনে রেখে তন্নীর পরিবার যাতে বুঝতে না পারে সে জন্য ওই দিন বিকালে তন্নীদের বাসার আশপাশে ঘুরাঘুরি করে বলে সুত্রে প্রকাশ। এদিকে তন্নী রায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতো তা একমাত্র ঘনিষ্ট বান্ধবী কান্তা রায় ব্যতিত তার পিতা-মাতা এমনকি ভাইও জানতো না। তন্নী নিখোঁজ হওয়ার পর কান্তা সে তথ্য তন্নীর পরিবারকে দেয়। নিখোঁজের দিন রাতেই তন্নীর পরিবার রানু রায়ের বাসায় যায়। সেখানে ওই সময় তন্নীকে পাওয়া যায় নি। কিন্তু পুলিশ মোবাইল কল লিষ্টের সুত্রধরে রানু রায়’কে ওই দিন গ্রেফতারের উদ্যোগ নিলে মানসম্মানের দিক বিবেচনায় তন্নীর পিতা তাতে সায় দেন নি বলে সুত্রে জানা গেছে। কে জানতো ভালবাসার মূল্য দিতে গিয়ে কলেজ ছাত্রী তন্নী রায় এমন নির্মম বলির শিকার হবে। অনেকের মতে ঘাতকরা তন্নী রায়’কে পাশবিক নির্যাতনের পর শ্বাসরোদ্ধ করে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য বস্তাবন্দি করে বরাক নদীতে ফেলে দেয়। এর আগে তার হাত-পা ডিস লাইনের তার দিয়ে বেঁেধ বস্তায় বন্দি করে ছামির কোম্পানীর ইট ব্যবহার করে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মোবারক হোসেন জানান, প্রেমিক রানু রায়’কে গ্রেফতারের জন্য সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তার ব্যবহৃত ফোন বন্ধ থাকায় অবস্থান সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না। তবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারসহ তাকে গ্রেফতারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। অভিজ্ঞ মহলের দাবী রানু রায়’কে গ্রেফতার করলেই কলেজ ছাত্রী তন্নী রায় হত্যার নেপথ্যে কারণসহ থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে। এছাড়া রানু রায়ের পরিবারের লোকজনসহ তার ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের প্রতি নজরদারী রাখছে পুলিশ।


     এই বিভাগের আরো খবর