,

দানবীর থেকে দেশান্তরী

সময় ডেস্ক ॥ রাগীব আলী। বিত্তবান বোঝাতে যার নাম ব্যবহূত হতো উপমা হিসেবে। তার অনুসারী ও শুভাকাক্সক্ষীদের কাছে শেষ ছিল না তার বিশেষণের। কারও কাছে তিনি ছিলেন দানবীর, কারও কাছে শিল্পপতি। জামায়াত-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ থাকলেও রাগীব আলী নিজেকে পরিচয় দিতেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে। রাগীব আলীকে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দানবীর দাবি করে শুভাকাক্সক্ষীরা দীর্ঘদিন ধরে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সেই ‘দানবীর’ এখন ফেরারি। জালিয়াতির মাধ্যমে সিলেটের তারাপুর চা বাগানের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল ও প্রতারণার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় আদালতের পরোয়ানা নিয়ে তিনি ছেলে-মেয়েসহ দেশান্তরী হয়ে ভারতে পালিয়েছেন। গতকাল দেশে ফেরার সময় জকিগঞ্জ কাস্টমস পুলিশ তার একমাত্র ছেলে আবদুল হাইকে গ্রেফতার করেছে। অবৈধ আয়ে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় এখন রাগীব আলীর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘নায়ক’ রাগীব আলীর জাল-জালিয়াতি ফাঁস ও সাম্রাজ্যের পতনের পর তিনি এখন পরিণত হয়েছেন খলনায়কে। তারাপুর চা বাগান গ্রাস : ১৮৯২ সালের ১০ জুন ব্রিটিশ মালিকানাধীন তারাপুর চা বাগান কিনে নেন বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত। ১৯১৫ সালে তিনি ওই বাগানটি দেবতার নামে লিখে দেন। এরপর থেকে ৪২৩ একরের ওই সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। ১৯৯০ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে রাগীব আলী তার ছেলে আবদুল হাইয়ের নামে দেবোত্তর সম্পত্তিটি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নেন। যেভাবে ধরা পড়ে জালিয়াতি : ১৯৯৯ সালের ২৫ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি একটি উপকমিটি গঠন করে তারাপুরের দেবোত্তর সম্পত্তি ইজারার বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। কমিটি দেখতে পায়, জালিয়াতির মাধ্যমে দেবোত্তর সম্পত্তি ইজারা নেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে চা বাগান পুনরুদ্ধারের সুপারিশ করে কমিটি। প্রতারণার মাধ্যমে দেবোত্তর সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাগীব আলী গংদের বিরুদ্ধে সিলেট সদরের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) দুটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই উচ্চ আদালতে রিট করলে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। গত ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হাইকোর্টের আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ তারাপুর চা-বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে অপসারণ করে চা বাগান সৃজন এবং প্রকৃত সেবায়েতের কাছে বাগানটি হস্তান্তরের আদেশ দেন। এ ছাড়া স্থগিত হওয়া দুটি মামলা পুনরায় সক্রিয় করারও নিদের্শনা দেন বিচারক। আপিল বিভাগের ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ মে জেলা প্রশাসন রাগীব আলীর কাছ থেকে তারাপুর বাগান উদ্ধার করে দেবোত্তর সম্পত্তির প্রকৃত সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয়। এ ছাড়া দেবোত্তর সম্পত্তিতে নির্মিত মেডিকেল কলেজ, হাসপাতালসহ সব স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়। যেভাবে দেশ ছেড়ে পলায়ন : ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে তারাপুর চা বাগানের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল ও আত্মসাতের অভিযোগে দায়েরকৃত দুটি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় চলতি বছরের ১০ জুলাই। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবি আই) সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সারোয়ার জাহান অভিযোগপত্র দুটি আদালতে দাখিল করলে ১০ আগস্ট শুনানি শেষে আদালত রাগীব আলী, তার একমাত্র ছেলে আবদুল হাইসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। পরোয়ানাভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন রাগীব আলীর আত্মীয় মৌলভীবাজারের রাজনগরের বাসিন্দা দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই, মেয়ে রুজিনা কাদির ও জামাতা আবদুল কাদির। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ওইদিন বিকালে জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান রাগীব আলী ও তার ছেলেমেয়ে। গতকাল রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই তার স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভারতের করিমগঞ্জ হয়ে জকিগঞ্জ কাস্টমস দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এ সময় তাকে ইমিগ্রেশন পুলিশ গ্রেফতার করে। গতকাল তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত আবদুল হাইকে কারাগারে পাঠিয়েছে। অবৈধ দখল দিয়ে শুরু সম্পদের পাহাড় গড়া : রাগীব আলীর উত্থান এরশাদ সরকারের আমলে। প্রবাস ফেরত রাগীব আলী ওই সময়ই তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পদ গড়তে থাকেন। সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের জায়গা দখল করে গড়ে তোলেন বহুতল মার্কেট। এ নিয়ে সিলেটে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে দীর্ঘদিন আন্দোলন চলে। আন্দোলন করতে গিয়ে দীর্ঘদিন জেল খাটতে হয় ওই সময়কার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্রনেতাদের। এরপরই রাগীব আলী জালিয়াতির মাধ্যমে দখলে নেন বিশাল তারাপুর চা বাগান। অবৈধভাবে ওই চা বাগানের জায়গা বিক্রিসহ সেখানে বিধিবহির্ভূতভাবে গড়ে তোলেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষক হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দাবি : রাগীব আলীর বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। তবে সম্প্রতি তিনি নিজেকে ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’ দাবি করে আসছিলেন। এ জন্য তার অনুসারী ও সুবিধাভোগীরা তারই অর্থে তাকে সংবর্ধনা দিয়ে একুশে পদক দেওয়ারও দাবি জানান। তবে সিলেটের মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি রাগীব আলী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তো দূরের কথা, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরও লোক নন। মুক্তিযোদ্ধাদের কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় বিশ্বের ২৬১টি ভাষায় প্রকাশিত ইন্টারনেটভিত্তিক বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতেও। সেখানে রাগীব আলীর সমালোচনা সম্পর্কে লেখা আছে, ‘রাগীব আলী সম্পর্কে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে থেকে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করা, যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তা করা ও হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল প্রভৃতি অন্যতম।’ এরশাদ সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধী দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন সিলেটের মানুষ। ওই সময় রাগীব আলী তার পৃষ্ঠপোষকতায় সাঈদীকে সিলেটে এনে ওয়াজ মাহফিল করান। ওই সময় সাঈদী রাগীব আলীর আতিথেয়তা গ্রহণ করে তার মালিকানাধীন চা বাগানের বাংলোয় অবস্থান করেন।


     এই বিভাগের আরো খবর