,

৪৭ বছর পর বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলেন এমপি কেয়া চৌধুরী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চুনারুঘাট উপজেলার আমুরোড বাজারে অতিকাছে গোছাপাড়া গ্রাম। এ গ্রামে কাছাকাছি পাল ও ধোপা বাড়ি। এসব বাড়ির বাসিন্দারা খুবই সহজ সরল। তারা শান্তিপ্রিয়। নিরিবিলি চলাফেলা পছন্দ করেন। ভালই চলছিলেন তারা। ১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধ চলাকালে জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখ পাক বাহিনী এ দুই বাড়িতে হানা দেয়। তারা লুটপাট চালিয়ে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। বাড়ির পুরুষদের মধ্যে অক্ষয় চন্দ্র শুক্লবৈদ্য, যতীন্দ্র চন্দ্র টেনু চন্দ্র শুকবৈদ্য, সুরেন্দ্র বট, রাখাল চন্দ্র শুকবৈদ্য, বিপিন পাল, হরেন্দ্র পাল, ভজেন্দ্র পালকে ধরে নিয়ে একে একে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে কৃপেশ পালের বাঁশ তলায় গর্তে পুতে রাখা হয় অক্ষয় চন্দ্র শুকবেদ্য, যতীন্দ্র চন্দ্র শুকবৈদ্য, টেনু চন্দ্র শুকবৈদ্য, সুরেন্দ্র বট, বিপিন পাল, হরেন্দ্র পাল, ভজেন্দ্র পালকে। রাখাল চন্দ্র শুকবৈদ্যের মৃত দেহ পাওয়া যায়নি। নারীদের ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন শুরু করে তারা। এ নিরীহ বাসিন্দাদের অপরাধ হলো, তারা নাকি মুক্তিবাহিনীকে খাবার দিয়ে সহায়তা করছিল। দেশ স্বাধীন হলো। কেউ পাল ও ধোপা বাড়ির লোকদের খবর নিচ্ছিলেন না। এদিকে চেতনায়-৭১ হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী’র কন্যা (বর্তমানে এমপি) কেয়া চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে ২০০৭ইং সালে এ দুই বাড়ির সন্ধান পান। তিনি ঘটনাস্থলে এসে উভয় বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলে পাকদের নির্যাতনের কাহিনী সম্পর্কে বিষদভাবে অবগত হন। সেই থেকে তিনি (এমপি কেয়া চৌধুরী) ধোপা বাড়ির বাসিন্দা পাকদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ রাখাল চন্দ্র শুকবৈদ্যের স্ত্রী বীরাঙ্গনা পুষ্প রানী শুকবৈদ্য ও যতীন্দ্র চন্দ্র শুকবৈদ্যের স্ত্রী বীরাঙ্গনা মালতি রানী শুকবৈদ্যকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি তাদেরসহ মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জের পঙ্গু, বীরাঙ্গনা ও সম্মুখ সমরে অংশ নেয়াসহ ৬ নারীকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করেন। তার ঐকান্তিক চেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর পুষ্প রানী ও মালতি রানী শুকবৈদ্যসহ ৬ নারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। অপরদিকে পাকদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হওয়া ৭ জনের বধ্যভূমির প্রাচীর নির্মাণে এমপি কেয়া চৌধুরী বরাদ্দ দেন। এ বরাদ্দের টাকা বধ্যভূমি নির্মাণের পাশাপাশি ৫ শহীদের পরিবারের মধ্যে সোলার প্যানেল দেয়া হচ্ছে। বাকী দুই শহীদের পরিবার প্রবাসে রয়েছে। বরাদ্দ দেয়ার পর ১৯ মে এমপি কেয়া চৌধুরী সরেজমিনে যান। সেখানে গিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্য ও নারী মুক্তিযোদ্ধাসহ তৃণমূলের লোকদের নিয়ে ৭ শহীদের বধ্যভূমিতে প্রাচীর নির্মাণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পূর্বে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এমপি কেয়া চৌধুরী। এ সময় আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা পুষ্প রানী শুকবৈদ্য ও মালতি রানী শুকবৈদ্য। তাদের চোখে অশ্র“ বন্ধ হচ্ছিল না। এ অবস্থায় সবার চোখে অশ্র“ এসে যায়। এ সময় এমপি কেয়া চৌধুরী বলেন, তাদের ঋণ কোন দিন শেষ হবার নয়। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৭ বছর। যাই হোক তারমধ্যেও জননেত্রী শেখ হাসিনা’র কাছ থেকে বরাদ্দ এনে শহীদদের বধ্যভূমি নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করতে পেরে ভাল লাগছে। তিনি বলেন, প্রাচীর নির্মাণ হবার পর, তাদের স্বরণে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণে বরাদ্দ দেব। ধোপা বাড়ির বাসিন্দা মন্টু চন্দ্র শুকবৈদ্য বলেন, পাক সেনারা আমার পিতা অক্ষয় চন্দ্র শুকবৈদ্য ও ভাই টেনু চন্দ্র শুকবৈদ্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। দেশ স্বাধীনের পর ২০০৭ সাল থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর কন্যা (বর্তমান এমপি) কেয়া চৌধুরী নিয়মিত আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আর কাউকে পাচ্ছি না। তিনি ৭ শহীদের বধ্যভূমিতে প্রাচীর নির্মাণ করে দিচ্ছেন। আমাদের সোলার প্যানেল বরাদ্দ দিলেন। তিনি শহীদের বধ্যভূমিতে স্মৃতি ফলক নির্মাণের ঘোষণা দিলেন। তার ঋণ আমরা শোধ করতে পারব না। শুধু তাই নয়, বীরাঙ্গনা পুষ্প রানী ও মালতি রানীকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞে স্বামীসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারান বীরাঙ্গনা মালতি রানী শুকবৈদ্য ও পুষ্পরানী শুকবৈদ্য। সম্পর্কে তারা ‘জা’। মালতী রানী শুকবৈদ্য জানান, একাত্তরের ১৩ জ্যৈষ্ঠ হানাদার বাহিনী তার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে স্বামী যতীন্দ্র শুকবৈদ্য, ভাসুর অয় শুকবৈদ্যকে পাল বাড়ির কাছে নিয়ে হত্যা করে। দেবর রাখাল শুকবৈদ্যকে গাড়িতে করে নিয়ে যায় এবং রাখালের স্ত্রী পুষ্পরানী শুকবৈদ্য ও তাকে সুখদেবপুর গ্রামের রশিদ মিয়ার বাড়িতে জিম্মায় রাখে। পরদিন ভোরে সেখান থেকে আমাদেরকে (মালতি ও পুষ্পকে) দূর্গাপুর গ্রামের রজব আলীর বাড়িতে নিয়ে যায় এবং এক মাস আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। এরপর এক ভিুক নারীকে দিয়ে পুষ্প রানী তার চাচার বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুলা গ্রামে খবর দেয়। তখন ওই এলাকার তৎকালীন চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ আত্মীয়-স্বজন এসে আমাদেরকে উদ্ধার করেন। এলাকায় ফিরে তারা দেখেন অগ্নিসংযোগের ফলে ভিটে ছাড়া আর কিছ্ইু অবশিষ্ট ছিল না। পুষ্পরানী শুকবৈদ্য বলেন, দুই সন্তানদের নিয়ে আর্থিক দৈন্যতায় দিনাতিপাত করছিলাম। তারা এখন রোজগারী। অবশেষে এমপি কেয়া চৌধুরীর চেষ্টায় আমরা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলাম। এমপি কেয়া চৌধুরী একের পর এক সহায়তা করছেন। এবার ৭ শহীদের বধ্যভূমিতে প্রাচীর নির্মাণসহ আমাদের সোলার বরাদ্দ দিলেন। বধ্যভূমিতে প্রাচীর নির্মাণ কাজের উদ্বোধনীতে অন্যন্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বধ্যভূমির জমিদাতা কৃপেশ পাল, যুবলীগ নেতা শেখ দেলোয়ার, তরুন পাল, উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মাশহুদুল ইসলাম, সাংবাদিক মোঃ মামুন চৌধুরী, মেম্বার হাজী আব্দুর রউফ, ছাত্রলীগ নেতা স্বপর সাই, সহ তৃণমূলে লোকেরা।


     এই বিভাগের আরো খবর