,

এক কিংবদন্তির প্রস্থান ॥ মহা অধ্যায়ের সমাপ্তি ॥ জীবনাবসান ঘটলো নায়করাজ রাজ্জাকের

সময় ডেস্ক ॥ এক কিংবদন্তির প্রস্থান। ইতিহাসের মহাঅধ্যায়ের সমাপ্তি। জীবনাবসান ঘটলো বাংলা চলচ্চিত্রের সম্রাট নায়করাজ আবদুুর রাজ্জাকের। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটের দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই অভিনেতা। ইন্নালিল্লাহি ……..রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। নায়করাজের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদসহ বিশিষ্টজনরা। নির্মাতা মনতাজুর রহমান আকবর ও পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন নায়করাজের পরিবারের বরাত দিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় জানান, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে ইউনাইটেড হাসপাতালে আনা হয় রাজ্জাককে। তখন তার পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ৬টা ১৫ মিনিটের দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে তার মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে শেষবার এক নজর দেখার জন্য ভিড় জমাতে থাকেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের অভিনেতা-অভিনেত্রী, প্রযোজক, পরিবেশক, নির্মাতাসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকে। প্রিয় নায়ককে হারিয়ে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ষাটের দশকের মাঝের দিকে রাজ্জাক চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ষাটের দশকের বাকি বছরগুলোতে এবং সত্তরের দশকেও তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রধান অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রাজ্জাক পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালের ২৩ শে জানুয়ারি। তার পিতার নাম আকবর হোসেন এবং মাতার নাম নিসারুন নেসা। রাজ্জাকের তিন ভাই তিন বোন। তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বরসতী পূজা চলাকালীন সময়ে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য ক্রীড়া শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিন্দ্রোহীতে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়ক রাজের অভিনয়ে মূলত সম্পৃক্ততা। তিনি সর্বপ্রথম কলকাতার ‘শিলালিপি’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৬২ সালে খায়রুন নেসাকে (লক্ষ্মী) বিয়ে করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম ঢাকায় আগমন করেন। তিন পুত্র (বাপ্পারাজ, বাপ্পি, সম্রাট) দুই কন্যা (শম্পা, ময়না) এবং স্ত্রী খায়রুন নেসাকে নিয়েই মূলত তার পরিবার। রাজ্জাক নায়ক হিসাবে প্রথম ‘বেহুলা’ ছবিতে অভিনয় করেন। তার সর্বপ্রথম প্রযোজিত ছবি ‘আকাঙ্ক্ষা’ এবং পরিচালক হিসাবে প্রথম ছবি ‘অনন্ত প্রেম’, এই পর্যন্ত তার অভিনীত মোট ছবির সংখ্যা প্রায় ৫০০। প্রায় অর্ধশত বছরের অভিনেতা হিসেবে রাজ্জাকের ঝুলিতে রয়েছে বাংলা ও উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছবি পেয়েছে ক্লাসিকের খ্যাতি। এক কথায় বলতে গেলে আগের দিনের তারকাদের মতো এখন তারকাদের নিকটও তিনি একজন আইডল। রাজ্জাকের সেরা প্রাপ্তি ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হওয়া। তার খ্যাতি নায়করাজ রাজ্জাক। রাজ্জাক তার অভিনয় জীবন নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রায় বলতেন, আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক সংগ্রাম করেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনোদিন আসেনি। আর আসেনি বলেই আজকে আমি এতদূর শান্তিতে এসেছি। ষোলটির মতো ছবি পরিচালনা করেছেন তিনি। তার সবশেষ পরিচালিত ছবিটির নাম ‘আয়না কাহিনী’, যেটি মুক্তি পায় ২০১৩ সালে। জানা যায়, নায়করাজ রাজ্জাক অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন সময় নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। নায়করাজ তার ক্যারিয়ারে অভিনয় ও চলচ্চিত্রের বাইরে কিছুই ভাবতে পারতেন না। দেয়া সবশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমি অভিনয় ও চলচ্চিত্রের বাইরে আর কিছুই জানি না। আর কিছু পারিও না। আল্লাহ আমাকে অনেক কিছু করার সুযোগ দিয়েছিলেন কিন্তু অভিনয়ের বাইরে আমি কিছুই করিনি। কাজ করতে করতে মারা যেতে চেয়েছিলেন ঢালিউডের এই মহানায়ক। রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘শ্লোগান’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘অতিথি’, ‘কে তুমি’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘পলাতক’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘রংবাজ’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ‘পিচঢালা পথ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’। রাজ্জাক সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ছেলে বাপ্পারাজ পরিচালিত ‘কার্তুজ’ ছবিতে। নায়করাজ রাজ্জাক প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন ‘কি যে করি’ ছবিতে অভিনয় করে। এরপর আরো চারবার তিনি জাতীয় সম্মাননা পান। ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। এছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্যবার। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষের ডাকে সাড়া দিতেন নায়করাজ রাজ্জাক। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথক শোক বার্তায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে রাজ্জাকের অবদানের কথা স্মরণ করেন তারা। এদিকে নায়ক রাজের মৃত্যুতে সংবাদ শুনে ইউনাইটেড হাসপাতালে ছুটে যান বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সাংস্কৃতির সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন উজ্জ্বল, জাসাস সভাপতি ড. মামুন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক অভিনেতা হেলাল খান ও সহ-সভাপতি শায়রুল কবির খান। এছাড়া চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেকে ভিড় করেন হাসপাতালে।


     এই বিভাগের আরো খবর