,

“পেছন ফিরে দেখা” থেকে শহীদ শাহ্ এ এম এস কিবরিয়া

“পেছন ফিরে দেখা”
একটি বইয়ের কভার পেজের নিছের দিকে চোখ পরতেই ভেসে উঠলো শাহ্ এএমএস কিবরিয়া নামটি। লাইব্রেরিয়ানকে বলে বইটা একটু পড়তেই অনেক ভাল লাগল। কিবরিয়া সাহেবের নিজের হাতে লিখা উনার অসমাপ্ত আত্মজীবনি না এনে পারলাম না। পুরু বইটা মনযোগ দিয়ে পড়ে শেষ করতে প্রায় বছর খানেক লেগে গেল। বইটির অনেক অংশ কয়েকবার করে পড়া হয়েছে, এত সুন্দর ভাবে সাজিয়েছেন উনার জীবনের স্মৃতিগুচ্ছ যত পড়ি ততই ভাল লাগে। কিছুদিন আগে হঠাৎ ভাবনাযুক্ত হল কিবরিয়া সাহেবের অসমাপ্ত আত্মজীবনি থেকে কিছু বিষয় কোন পত্রিকার মাধ্যমে আবার পুনঃপ্রচার করার, তাই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। “পেছন ফিরে দেখা” থেকে শুরু করতে হলে যেতে হয় ব্রিটিশ আমলে, কথাটা আরেকটু খোলাসা করে বললে এভাবে বলতে হয় যে কিবরিয়া সাহেবের জন্ম ১৯৩১ সালে এবং তখন ছিল ব্রিটিশদের শাসনামল। তৎকালিন ব্রিটিশ সম্রাজ্যের পূর্ব সিমান্তের আসাম প্রদেশের হবিগঞ্জ মহকুমায় ১৯৩১ সালের ১লা মে উনার জন্ম হয়েছিল, উনার বাল্যকাল তিরিশের দশকে এখানেই কেটেছে। প্রাথমিক শিক্ষালাভের কথা পেছন ফিরে দেখাতে তেমনভাবে পাইনি, তাই অধ্যাপক ওমর ফারুক সম্পাদিত ও আবুল কালাম আজাদ ছোটন রচিত “একজন কিবরিয়া” বইয়ের বরাত দিয়ে বলছি কিবরিয়া সাহেব উনার প্রাথমিক শিক্ষালাভ শুরু করেছিলেন বিয়ানিবাজারে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এই বই থেকে আর জানা যায় তিনি বানিয়াচং এর যাত্রাপাশা প্রাথমিক বিদ্যালয়েও তিনি পড়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে বানিয়াচং উপজেলার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি মাত্র তিন মাস পড়েছিলেন এ তথ্যটাও “একজন কিবরিয়া” থেকে নেয়া। যাই হোক এবার ফিরছি কিবরিয়া সাহেব রচিত “পেছন ফিরে দেখাতে, তিনি হাই স্কুল জীবন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে শেষ করেছিলেন। হবিগঞ্জ থেকে এসএসসি পাশ করে পরবর্তিতে ১৯৪৭ সালে সিলেট এমসি তে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট এ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম স্থান অধিকার করেন। উল্লেখ্য যে, যখন কিবরিয়া সাহেব ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে এ স্তরের পরীক্ষা নেয়া হত। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম বিভাগে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রীলাভের পর সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে পাকিস্তানের বৈদেশিক বিভাগে যোগদান করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে ফ্লেচার স্কুল অব ল এবং যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ ফরেইন অফিসে কূটনৈতিক সেবায় আরো দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। আসলে কিবরিয়া সাহেবের শিক্ষা জীবনের স্মৃতিচারণ নিয়ে লিখলে বা উনার প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত লিখা লিখতে চাইলে বিরাটকার কয়েকটি কলামের প্রয়োজন। তাই এর সমাপ্তি টেনে একটা মজার ঘটনা তুলে ধরছি। কিবরিয়া সাহেব তখন ঢাবিতে পড়েন, একদিন ডাইনিং হলে গিয়ে শুনতে পেলেন খাবারে লবণ নেই। লবণহীন খাবার খেতে হবে। তা কি আর হয়। সঙ্গে সঙ্গে কিবরিয়া সাহেব সহ সকল ছাত্ররা মিলে মিছিল নিয়ে ধাবিত হলেন সচিবালয় পর্যন্ত। সে সময় সচিবালয় পৌছাতে কোন বাধা ছিল না। বিকেল বেলা মাঠে টেনিস খেলায় গেলেন মিছিল শেষ করে। মাঠ থেকে দেখতে পেলেন একটা পতাকাবাহী গাড়ি এক বস্তা লবণ নামাচ্ছে। খুব সহজেই লবণহীন খাবারের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন সফল হল। কিবরিয়া সাহেবের দৈনন্দিন কার্যতালিকার অংশের মধ্যে রবিন্দ্রনাথের গল্প ও কবিতা পাঠ ছিল অন্যতম। উনার প্রিয় ইচ্ছার কথা বলতে গেলে বলতে হয় বেদেশি লেখকদের লেখা বই পড়ে বিদেশ ভ্রমনের আকাংক্ষা ছিল জীবনের সূচনালগ্নে। পাঠক মহলকে এবার একটু বিয়ের পিরিতে নিয়ে যাচ্ছি। তৎকালিন সিলেটের ডিসি আলী আহমদ সাহেবের দ্বিতীয় কন্যা আসমার সাথে কিবরিয়া সাহেবের বিয়ের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছিলেন উনার পিতা মাতা। আসমা’র (ডাক নাম ইভা) এবং আসমা পরিবারের চালচলন সবই কিবরিয়া পরিবারের খুব পছন্দ হয়েছিল। কিবরিয়া সাহেবের পিতা চাননি পুত্রের উপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে। তাই তিনি কিবরিয়া সাহেব কে কন্যা পছন্দের বিষয়ে বলেছিলেন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে। কিবরিয়া সাহেবেরও খুব পছন্দ হয়েছিল তাই সুভষ্য শিঘ্রম নীতি মানে ভাল কাজে দেরি করতে নেই এটা ভেবে ১৯৫৪ সালে বিয়ের পিড়িতে বসে পরলেন। ১৯৫৭ সালের ৬ মার্চ তিনি তার প্রথম সন্তান আজকের ড.রেজা কিবরিয়া সাহেবের বাবা হলেন এবং কায়রোতে থাকাকালীন ১৯৬১ সালের ১১ জানুয়ারি জন্ম নিলেন তার ২য় কন্যা সন্তান আজকের ড.নাজলি কিবরিয়া। উল্লেখ্য যে, কিবরিয়া সাহেব ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান পররাষ্ট্র সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে নবগঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মহাপরিচালক (রাজনৈতিক) বিষয়ক হিসেবে যোগদান করেন। একই সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ফিজিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার, জেনেভায় জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত এবং স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে জাতি গ্র“প ও নৌপরিবহন সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে পররাষ্ট্র সচিব, ১৯৮১ সালে এসকাপের নির্বাহী সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যাম্বোডিয়ায় মানবিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা ও সমন্বয় বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন এবং রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার এর অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০০১ সালে তিনি হবিগঞ্জ-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ সালের এপ্রিল মাস থেকে আমৃত্যু “মৃদুভাষণ” নামে উনার প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি উনার জন্মস্থান ও নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জের বৈদ্যারবাজার নামক স্থানে দলীয় এক আলোচনা সভা শেষে মঞ্চ ত্যাগের সময় অনাকাংক্ষিত এক গ্রেনেড হামলায় আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলি ক্ষণজন্মা এই মহান রাজনীতিবিদকে। কিন্তু শুধু আজই নয় আরও হাজার বছরও লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালির হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে একটি নাম শহীদ শাহ্ এএমএস কিবরিয়া।


     এই বিভাগের আরো খবর