,

বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতি

[২য় সংখ্যার পর] (শামছুল হুদা চৌধুরীর লেখা ‘একাত্তরের রণাঙ্গনে’ বইটিতে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে)। এই ঘটনায় শেখ ফজলুল হক মণি ক্ষেপে যান এবং মুজিব বাহিনীর হার্ডকোর সদস্যদের মেজর জিয়া ও উক্ত আর্মি অফিসারকে বন্দি করে মুজিব বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। ধৃর্ত জিয়া আগেই তাহা টের পেয়ে শেখ ফজলুল হক মণির কাছে লেখা দীর্ঘ এক চিঠিতে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাকে জানান মুজিব বাহিনীর সদস্যদের উত্যক্ত করা ইচ্ছাকৃত নয়। ইহা ভুল বুঝাবুঝির ফল। তিনি পাঁচ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের বাড়াবাড়ির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনার পূনরাবৃত্তি হবেনা বলে প্রতিশ্র“তি দেন। মেজর জিয়ার লেখা এই চিঠি দীর্ঘকাল শেখ মণির কাছে মুজিব বাহিনী সংক্রান্ত গোপন ফাইলে সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগষ্ট রাতে শেখ মণিকে হত্যা করার পর ঢাকার বাসায় হত্যাকারীরা কোন কিছুই লুঠ করেনি, শুধু মুজিব বাহিনী সংক্রান্ত বিরাট ফাইলটি শেখ মণির বাসা থেকে উধাও হয়ে যায়। সুতরাং শেখ মুজিবকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মণিকে হত্যা করা ইহা কোন আকস্মিক ঘটনা নয় বরং এই বিরোধের বীজ রোপিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তঝরা দিনগুলিতেই। সরকারী খরচে মুক্তিযুদ্ধের বস্তাপচা মিথ্যা ইতিহাস লেখার চাইতে আজ মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস প্রকাশ করার সময় এসেছে। তাহালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল শক্র কারা? তা ধরা পরবে এবং তাদের দেশপ্রেম ও বীরত্বগাঁথার ছদ্দাবেশ ফুটো হয়ে চক্রান্তকারীর আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পর্যন্ত মেজর জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর উক্ত আর্মি অফিসার (যিনি মুজিব বাহিনীর একটি ছোট গ্র“পের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিলেন) জেনারেল ওসমানী কর্তৃক দু’বার সাসপেন্ড হন এবং আসামের তুরা, আলীপুর দুয়ার ও মেঘালয়ে তিনি দুইমাসকাল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে থাকেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর মেজর জিয়াউর রহমান উক্ত আর্মি অফিসার এবং অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে সিলেট শহরে উপনিত হন। জানা যায় এ সময় কিছু হিন্দু রাজবাড়ী থেকে (পরিত্যাক্ত) প্রচুর সোনার অলংকার লুটপাট হয়। সিলেটের কালীঘাটের আদম লিমিটেডের সমস্ত তেল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র এসময় লুটপাট হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের জেটি এলাকায় বিহারী ও পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া যাবতীয় মূল্যবান জিনিসপত্র আর্মি অফিসারদের পকেটে চলে যায়। নিজেদের দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তি ঢাকা দেওয়ার জন্য বাঙ্গালী অফিসারদের একটি দল দেশ মুক্ত হওয়ার পরপরই প্রচারণা শুরু করে যে, ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে সব কিছু লুট করে ভারতে নিয়ে গেছে। তারা মুজিব বাহিনীর নেতাদের বিরুদ্ধেও প্রচারণা শুরু করে। শাহাজান সিরাজ, সিরাজুল আলম, আসম রব ও নুরে আলম ছিদ্দিকীকে “চার খলিফা” আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ঢালাও প্রচারণা শুরু করে। এই প্রচারণায় গোপনে কণ্ঠ মেলাতে শুরু করে গ্রামে গঞ্জে পলাতক, রাজাকার, আলবদরের দল এবং পিকিং ও জামাতপন্থীরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদি মুক্তি বাহিনীর কোন কোন সেক্টর কমান্ডার এবং তাদের সহচরদের বাসভবন সার্চ করার ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে আজ বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং স্বাধীনতার আদর্শের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের বহু আগে পাকিস্তানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত, পাকিস্তানের আর্মি ইনটেলিজেন্সের সঙ্গে একসময় যুক্ত একদল বাঙ্গালী আর্মি অফিসারই গোপনে প্রচারণা ও ষড়যন্ত্র শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের আগেই এই ষড়যন্ত্রের শুরু। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের অনভিজ্ঞ নেতারা এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কিছুমাত্র আচঁ করতে পারেননি। অন্যদিকে সুকৌশলে ভারত বিরুধী প্রচারণা দ্বারা এমনভাবে জনমনকে বিষাক্ত করে তোলা হয়েছিল যে, স্বাধীন বাংলাদেশে একদল আর্মি অফিসারের পাকিস্তানের মতো ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত ও প্রস্তুতি সম্পর্কে ভারতের হুশিয়ারী গ্রাহ্য করা আওয়ামীলীগ নেতারা প্রয়োজন বোধ করেননি। এর প্রায়শ্চিত্ত তাদের করতে হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট রাত্রে অত্যান্ত মর্মান্তিকভাবে। শুধু মুজিব বাহিনী নয়, কাদের ছিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রতিও মেজর জিয়া ও তার দলবলের মনোভাব যে ভাল ছিলনা তা আগেই বলেছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অসামরিক তরুনদের নিয়ে একটা বিরাট গণবাহিনী গড়ে উঠতে পারে এবং পাকিস্তানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত পেশাদার আর্মি অফিসারদের ক্ষমতা ও প্রভাব চলে যেতে পারে এই ভয়ে তারা সবসময় ভীত ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তারা সুকৌশলে বিরূপ প্রচারণা চালাতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বাস করতেন কলকাতায় থিয়েটার রোডে একটি বাসভবনে। এটি অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহ্রাওয়াদীর সরকারী বাসভবন ছিল। আর জেনারেল ওসমানীর হেড কোয়ার্টার ছিল সার্কাস এভিনিউতে বাংলাদেশ দূতাবাস ভবনে। (এই ভবনেই পাকিস্তানী দূতাবাস ছিল এবং এখানেই ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।) মেজর জিয়াউর রহমান মাঝে মাঝে তার সেক্টর থেকে উপদেশ ও নির্দেশ লাভের জন্য আগরতলায় যেতেন এবং কখনও কলকাতায় হাইকমান্ডের কাছে যেতেন। ফিরে এসে তিনি আর্মি সহকর্মীদের কাছে যে ধরনের জোক (তামাশা) করতেন তা ছিল অত্যান্ত আপত্তিকর। চলবে…
বি: দ্র: লেখাটি বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রকাশিত


     এই বিভাগের আরো খবর