,

১৩৯ জনের ফাঁসি, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন ১৯৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা

সময় ডেস্ক ॥ পিলখানা হত্যাকান্ডের ঘটনায় করা মামলার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। রায়ে ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসি, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন ও ১৯৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে হাইকোর্ট। গতকাল সোমবার বিকেলে বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী ও মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার। আদালত এ রায়কে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে রায়ে বিভিন্ন সুপারিশও করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফ্রেরুয়ারি পিলখানার বিডিআর সদর দফতরে ৫৭ জন সেনা সদস্যসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালত রায় দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ৬ নভেম্বর এ মামলায় ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন বিচারিক আদালত। এঁদের একজন ছাড়া সবাই তৎকালীন বিডিআরের সদস্য। যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয় ১৬ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরও ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন আসামি। সাজা হয় মোট ৫৬৮ জনের। হাইকোর্টে কোনো রায় পড়তে দুদিন সময় লাগার বিয়ষটি অনেক আইনজীবীই নজিরবিহীন বলেছেন। এ মামলায় আদালত এক হাজার পৃষ্ঠার বেশি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। সম্পূর্ণ রায় প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। আদালত বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে গণতন্ত্র ধ্বংস করাই ছিল বিদ্রোহের অন্যতম উদ্দেশ্য। গতকাল রায় পড়তে গিয়ে বিচারপতি নজরুল বলেন, তৎকালীন বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দারা কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে তা আগে জানতে পারেনি, সেই ব্যর্থতা খুঁজতে একটি তদন্ত কমিটি করা দরকার। তিনি মহাপরিচালকের উদ্দেশে বলেন, কোনো সমস্যা এলে তা তাৎক্ষণিক সমাধান করতে হবে। বিজিবির জওয়ানরা কোনো সমস্যা নিয়ে এলে তা মীমাংসা করতে হবে এবং বিজিবিতে সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানদের মধ্যে পেশাদারি সম্পর্ক থাকতে হবে। নজরুল ইসলাম প্রশ্ন করেন, কেন সে সময়ের বিডিআর ডাল-ভাত কর্মসূচি নিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো কর্মসূচি যেন না নেওয়া হয়, সে ব্যাপারে বিজিবিকে সতর্ক করেন তিনি। আরেক বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেন বলেন, কোনো সেনা কর্মকর্তা সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে থাকবে না, এটাই ছিল বিদ্রোহে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মূল মনোভাব। তিনি জওয়ানদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক (কলোনিয়াল) আমলের মতো ব্যবহার না করার কথা বলেন। তিনি বলেন, একই দেশ। এখানে সবাই ভাই ভাই। গতকাল রোববার আদালত পর্যবেক্ষণে নারকীয় এ হত্যাকান্ডকে নৃশংস ও বর্বরোচিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালত বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন ইপিআর পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সীমান্তরক্ষায় নিয়োজিত এই বাহিনী দেশে-বিদেশে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে পিলখানায় তৎকালীন বিডিআরের কিছু সদস্য আইনকে বৃদ্ধাংগুল দেখিয়ে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন। এই কলঙ্কচিহ্ন তাঁদের অনেক দিন বয়ে বেড়াতে হবে। একসঙ্গে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার নজির ইতিহাসে নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় মনোবল নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যৌক্তিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এরপর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দন্ডিত ব্যক্তিরাও জেল আপিল ও আপিল করেন। ৬৯ জনকে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এসবের ওপর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৩৭০তম দিনে গত ১৩ এপ্রিল। সেদিন শুনানি শেষে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এরপর হাইকোর্ট রায়ের জন্য ২৬ নভেম্বর তারিখ ধার্য করেন। নিম্ন আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দন্ডিত ব্যক্তিরাও জেল আপিল ও আপিল করেন। ৬৯ জনকে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এসবের ওপর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৩৭০ তম দিনে, ১৩ এপ্রিল। সেদিন শুনানি শেষে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এরপর হাইকোর্ট রায়ের জন্য ২৬ নভেম্বর তারিখ ধার্য করেন। নিম্ন আদালতের রায় ঃ বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকায় এক নম্বরে ছিলেন বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনাকারী উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলম। বিডিআরের বাইরে দুজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। এঁরা হলেন বিএনপির সাবেক সাংসদ নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলী। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে কারাগারে মারা যান নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু। নিম্ন আদালতের রায়টি ছিল মোট চার হাজার পৃষ্ঠার। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক তখন বলেছিলেন, এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা। একটি বিদ্রোহ থেকে এ হত্যাকান্ড ঘটেছে। তবে যে কারণে এ বিদ্রোহ হয়েছে, তা ছিল অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন। সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট করা, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা এবং দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়াই ছিল হত্যাকান্ডের অন্যতম কারণ। আদালত ১৫২ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়ে বলেন, মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এঁদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত সাধারণ নাগরিক হলেন পিলখানার পাশের এলাকার বাসিন্দা নায়েক সুবেদার (অব.) কাঞ্চন আলীর ছেলে জাকির হোসেন। পিন্টু ও তোরাব আলীকে যাবজ্জীবনের পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়; অনাদায়ে আরও পাঁচ বছরের কারাদন্ডের আদেশ দেন আদালত। ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে অস্ত্র লুণ্ঠনের দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদন্ড দেন আদালত। এতে করে তাঁদের ৪০ বছরের সাজা হয়। ২৫৬ জনের মধ্যে ২০৭ জনকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে তাঁদের আরেকটি অভিযোগে আরও তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়। এ নিয়ে মোট ১৩ বছর কারাভোগ করতে হবে তাঁদের।


     এই বিভাগের আরো খবর