,

হবিগঞ্জে বৃষ্টিতে ইটভাটার ২০ কোটি টাকার ক্ষতি

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি ॥ টানা চার দিন ধরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও ভারী বর্ষনে হবিগঞ্জ জেলার ৮০টি ইটভাটার মালিকদের প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টানা বৃষ্টির কারনে কাঁচা ইট নষ্ট হয়ে গেছে। কাঁচা ইট কাটতে পারছে না শ্রমিকরা। হাজার হাজার শ্রমিকদের বসে বসে খাওয়াচ্ছে ইটভাটা মালিকরা। গত শুক্রবার রাত থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। শনিবার দিনগত রাত থেকে তা রুপ নেয় ভারি বর্ষণে। রোববার রাতের বৃষ্টিতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। সাথে দমকা হাওয়া সহ ঝড় বৃষ্টি। কাঁচা ইট পলিথিন দিয়ে ঘুরে রাখা হলেও শনিবার রাতের দমকা হাওয়ার সাথে ঝড় বৃষ্টিতে পলিথিন গুলি নষ্ট করে দিয়েছে।  ভারী বর্ষণের ফলে বেশ কয়েকটি ইটভাটা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। মাত্র কয়েকদিন আগে ইটভাটার মৌসুম শুরু হয়েছে।  কার্তিক মাসের প্রথম থেকে ইটভাটার কাজ শুরু হয়। কাঁচা ইটকাটার স্থান শুকিয়ে পঠ তৈরি করে স্থান প্রস্তুত করে সব ইটভাটায় পুরোদমে ইটকাটা শুরু করে দিয়েছে। বেশ কয়েকটি ইটভাটায় আগুনও জ্বালিয়ে দিয়েছে। আগুন দিয়েও ইটভাটার মালিকরা পড়েছে বেকায়দায়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কারনে তারা চেম্বার দিতে পারছে না। রেজার লোকজন পঠ থেকে কাচা ইট এনে সাজাই দিতে না পারার কারণে আগুন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। প্রতিটি ইট ভাটায় প্রায় দুইশত শ্রমিক কাজ করছে। শ্রমিকদের কাজ না থাকায় মালিকরা পড়েছে মোটা অংকের লোকশানে। কাজ ছাড়াই তাদেরকে দিতে হচ্ছে সাপ্তাহিক খোরাকী। সোমবার (১১ ডিসেম্বর) বিকেলে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে জেলার বেশ কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্থ ইটভাটা ঘুরে দেখা যায়, ইট তৈরির মৌসুমের শুরুতেই বৈরি আবহাওয়ার কারণে মালিক ও শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। বেশ কিছু মেইল শ্রমিকরা বৃষ্টির কারনে কাজ করতে না পারায় বাড়িতে চলে গেছে। বৃষ্টির কারনে আগুন মেস্ত্রীরা টাইম মারতে পারছে না। অনেক ইঠভাটায় চেম্বার ভেঙ্গে যাওয়ার কারনে আগুন নিয়ে সামনে যেতে না পারায় আগুন বন্ধ হওয়ার পথে। দুপুরে বাহুবল উপজেলার পলাশ ব্রিকস, সানমুন ব্রিকস, নিউ পদ্মা ব্রিকস, শাকিল, সুরমা ব্রিকস সহ বেশ কয়েকটি ইটভাটা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পঠে পানি উঠার কারনে চন্তরে ঝিক দিয়ে রাখা কাঁচা ইটগুলি ধ্বসে পড়ে যাচ্ছে। সোমবার সকালে হালকা বৃষ্টি হলেও দুপুরের পর থেকে আকাশ মেঘলা রয়েছে। যে কোন সময় ঝড়তে পারে বৃষ্টি। খোরাকী না পেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাঠাচ্ছে শ্রমিকরা। ইটভাটার মালিকরা জানান, প্রত্যেক মৌসুমে এসব ভাটায় কয়েক দফায় ইট তৈরি করা হয়। সে অনুযায়ী প্রতিটি ভাটায় বছরে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ ইট তৈরি হয়। অধিকাংশ ইট ভাটায় প্রথম দফায় ইট তৈরি করা হচ্ছে। তারা জানান, এক হাজার ইট তৈরিতে খরচ হয় প্রায় পাঁচশত টাকা এবং এক লাখ ইট তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। বেশ কয়েকদিন ধরে ভাটা মালিকরা কাঁচা ইট তৈরি করে রোদে শুকিয়ে তা পুড়িয়ে পাকা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু চার দিনের বৃষ্টির কারণে পানিতে ভিজে সদ্য তৈরি কাঁচা ইট ভেঙে নষ্ট হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এতে ৮০টি ইটভাটা মালিকের প্রায় ৪ কোটি কাঁচা ইট ধ্বংস হয়ে গেছে। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার নাবিল ব্রিকসের মালিক ছালেক মিয়া  জানান, তিন দিনের বৃষ্টিতে কাঁচা ইটের ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। যে ক্ষতি এই মৌসুমে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এ বছর তার বড় অংকের লোকসান গুনতে হবে। গত সপ্তাহে আগুন দিয়েছি, বর্তমানে পঠে শুকনা মাল না থাকার কারনে আগুনের ষ্টাফ মাল পুড়তে পারছে না। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার প্রতিষ্টিত সুপার ব্রিকসের ম্যানেজার আব্দুল লতিফ জানান, কয়েকদিন আগে তৈরি করা ইট রোদে শুকানো হচ্ছিল। কিন্তু অসময়ে বৃষ্টির পানিতে ভিজে ইটগুলো গলে মাটিতে মিশে গেছে। এতে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিসহ মাঠ পরিস্কার করতে অতিরিক্ত অনেক টাকা খরচ হবে। বাহুবল উপজেলার সততা ব্রিকস্ এর মালিক শামছুল আলম বলেন, এমনিতে নানা কারণে ইটের ব্যবসা এখন আর আগের মতো লাভজনক নেই। গুড়ি গুড়ি ও অকাল ভারি বর্ষণে ইটভাটার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নানা উপকরণ মূল্য ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির বাজারে এই ক্ষতি পুষিয়ে অনেকের পক্ষে ইট উৎপাদনে ফিরে আসা দূরহ হয়ে পড়বে। নেত্রকোনা থেকে আসা রেজার সর্দার মোজাম্মেল  জানান, গত মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ৩০ জন লেবার নিয়ে সুপার ব্রিকসে এসেছিলাম। ৪০ চেম্বার মাল লুট দেওয়ার পর থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত লেবারদের বসে বসে খাওন দিচ্ছি। আমরা প্রতি হাজারে কাজ করি, কাজ না করলে কোম্পানী বেতন দেয় না। কবে যে বৃষ্টি কমবে আর কাজ শুরু করব আল্লা মালুম। বি-বাড়িয়া জেলার অষ্টগ্রাম থেকে আসা মেইল সর্দার গিয়াস উদ্দিন জানান, প্রোডাকশনে মেইল নিয়ে মিরপুরের কয়েকটি ইটভাটায় লেবার নিয়ে এসছিলাম। বৃষ্টির কারনে মাল না কাটতে পেরে লেবারগুলো বাড়িতে চলে গেছে। আরও দু একদিন এভাবে চলতে থাকলে আগুন বন্ধ হয়ে যাবে। তখন মালিকরা পড়ে যাবে আরও বড় অংকের লোকশানে। হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলা, নবীগঞ্জ উপজেলা, চুনারুঘাট উপজেলা, মাধবপুর উপজেলা, বানিয়াচং উপজেলা সহ বেশ কয়েকটি ইটভাটায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইট পোড়ানোর অপেক্ষায় রাখা কাঁচা ইট বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।  ইটভাটা মালিকদের ইট পোড়ানোর কাজ আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। অনেকেই পুঁজি হারিয়ে নতুন করে এ বছর ইট পোড়ানোর কাজ শুরু করতে পারবেন না। এতে এ বছর ইটের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ইটের সংকট দেখা দিতে পারে। শুরুর প্রথম দিকেই তারা হোচট খেয়েছে পরবর্তিতে আরও বৃষ্টির কবলে পড়লে তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায়ন্তর নেই বলেও জানা বেশ কয়েকটি ইটভাটার মালিক ম্যানেজার। হবিগঞ্জ ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা কুতুব উদ্দিন সোমবার দুপুরে  বলেন, ‘আকস্মিক গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ও ভারি বৃষ্টিতে ইটভাটা মালিকদের চরম ক্ষতি হয়েছে। আমাদের ৮০টি ইটভাটায় প্রায় ৪ কোটি কাঁচা ইট নষ্ট হয়ে গেছে। কম করে হলেও প্রতিটি ইটভাটায় পাঁচ লক্ষ মাল নষ্ট হয়েছে। পঠ থেকে নষ্ট মাল সরাতে আরও খরচ হবে প্রায় ৫ কোটি। সব ভাটায় মিলিয়ে গড়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষতিতে পড়েছি আমরা। তিনি আরো বলেন, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ না পেলে অনেকেই আর ইট তৈরি করতে পারবেন না।’


     এই বিভাগের আরো খবর