,

৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী

সময় ডেস্ক ॥ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেকটা জনতুষ্টির বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চলতি বাজেট থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়লেও অনেক দিক সামলে সবার মন জয়ের চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। ভোটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন উদ্যোগ প্রস্তাবিত বাজেটে খুব একটা নেই। বরং কিছু ক্ষেত্রে ভোটারের মন জয়ের চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২৫ এবং মূল বাজেটের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। গতকাল দুপুরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। তার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর বাজেট প্রস্তাবে সই করেন প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ। বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা, যার ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা যাবে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)। অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি। অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে ৫৮ হাজার ৫১২ কোটি টাকা যাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে। যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের ২০ দশমিক ৭১ শতাংশ। বাজেটের ৭৩ শতাংশ অর্থ রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটকে রাজনৈতিক বাজেট হিসেবে উল্লেখ করে তা বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। শিল্প ও বণিক সমিতির নেতারা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট শিল্প ও বাণিজ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। বিএনপি বাজেটকে নির্বাচনী এবং লুটপাটের বাজেট বলে আখ্যা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদের এ বাজেট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পেশ করা ১২তম। ৮৫ বছর বয়সী মুহিতের এটি টানা দশম বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লক্ষ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্যসংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, এক লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৮২ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা করা হয়। আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে ১ লাখ ৭১৯ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ৭৭ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৩২ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৪৮ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৩৬ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ২ হাজার ৯০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক অনুদান থেকে চার হাজার ৫১ কোটি টাকা পাওয়া যাবে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটে আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। ঘাটতির এই পরিমাণ মোট জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে এই ঘাটতি পূরণের লক্ষ্য নির্ধারণ হয়েছে।  বিদশি ঋণ থেকে ৫০ হাজার ১৬ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা সংস্থানের পরিকল্পনা করা হয়েছে বাজেটে। অর্থমন্ত্রী তার ১১০ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফিতি ৫.৬ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে খাতভিত্তিক সম্পদ বিভাজনে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে জনপ্রশাসনে ১৮ শতাংশ।  দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১৪ দশমিক ৬ ভাগ। এ ছাড়া পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১২ দশমিক ২ ভাগ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ৭ ভাগ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৫ দশমিক ৭ ভাগ, প্রতিরক্ষায় ৬ দশমিক ৩ ভাগ, কৃষিতে ৫ দশমিক ৭, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ৫ দশমিক ৪ এবং স্বাস্থ্য খাতে ৫ শতাংশ। এ ছাড়া মোট বাজেটের ১১ দশমিক ১ ভাগ বরাদ্দ রয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধে। বাজেটে এবারও করমুক্ত আয় সীমা আড়াই লাখ টাকাই রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরের কোম্পানি করদাতা ছাড়া অন্যান্য করদাতাদের যথাক্রমে ৫, ৪ ও ৩ হাজার টাকা ন্যুনতম কর পরিশোধ করতে হবে। এই কর হার বিদায়ী অর্থ বছরের মতোই থাকছে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ব্যক্তিগত করদাতার প্রদর্শিত সম্পদের ভিত্তিতে সারচার্জ আরোপের কথা বলেছেন। নিট পরিসম্পদ ২ কোটি ২৫ লাখ থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ১০ ভাগ সারচার্জ দিতে হবে। কোনো করদাতার নিজের নামে দুটি গাড়ি বা কোনো সিটি করপোরেশন এলাকায় আট হাজার বর্গফুটের গৃহ সম্পত্তি থাকলে তাকেও একই ধরনের সারচার্জ দিতে হবে। ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত নিট পরিসম্পদ থাকলে ১৫, ১৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ২৫ এবং ২০ কোটি টাকার বেশি নিট সম্পত্তিধারীদের ৩০ শতাংশ হারে সারচার্জ প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ২০৩০ সালের মধ্যে বিড়ি এবং ২০৪০ সালের মধ্যে সিগারেট পুরোপুরি বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে অর্থমন্ত্রী তামাক পণ্যের ওপর কর বাড়িয়েছেন। বাজেটে ১৮০০ সিসি পর্যন্ত হাইব্রিড গাড়ি আমদানির সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। গুঁড়োদুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে। স্থানীয়ভাবে তৈরি মোটরসাইকেল উৎপাদনকারীদের ভ্যাট অব্যাহতি এবং দেশে তৈরি হয় না, এমন ধরনের কিছু সফটওয়্যার আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানো, ক্যানসার প্রতিরোধক ওষুধ প্রস্তুতের উপকরণের উপর রেয়াতি সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে। প্রস্তাবিত বাজেটে এনার্জি ড্রিংকের উপর সম্পূরক শুল্ক ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সিগারেট ও বিড়ির কাগজের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ এবং হাতে তৈরি বিড়ির খুচরা মূল্যহার বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে। সব ধরনের প্রসাধন সামগ্রীর উপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। আতর ও আগরবাতি ছাড়া সব ধরনের সুগন্ধিতে সম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে সব ধরনের পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগের উপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছে। হেলিকপ্টার সেবায় ২০ শতাংশ এবং উবার পাঠাওয়ের মতো শেয়ারিং রাইডে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এদিকে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর একটি রূপরেখা তুলে ধরেছেন। প্রস্তাবিত বাজেট থেকেই এর পাইলটিং শুরুর আশা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া বাজেটে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার এবং নাতি-নাতনিদের সহযোগিতার জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং ১লা বৈশাখ ও বিজয় দিবসে সব মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ ভাতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। অর্থমন্ত্রী ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক ১১০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতায় আশা করেন রাজস্ব আহরণ ও সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংস্কারের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাজস্ব পরিসর বাড়ারও আশা করছেন মুহিত। প্রস্তাবিত বাজেট ৯২ শতাংশ বাস্তবায়নের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।


     এই বিভাগের আরো খবর