,

সংসদে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে এমপি মুনিম চৌধুরী বাবু’রবক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
মাননীয় স্পীকার, আপনাকে ধন্যবাদ, গত ৭ জুন এই মহান সংসদে উপস্থাপিত ২০১৭-১৯ অর্থ-বছরের বাজেটের উপর বক্তব্য দেয়ার সুযোগ প্রদানের জন্য আপনাকে আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি। টানা ১০ বার এবং মোট ১২ বার এই সংসদে বাজেট উপস্থাপনের বিরল সম্মান অর্জনের জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিতকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ। এটাই এই সরকারের শেষ বাজেট এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রীরও হয়তোবা শেষ বাজেট। মাননীয় স্পীকার, আমার বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি সাবেক সফল রাষ্ট্রনায়ক পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সময়ের সাহসী রাজনীতিবিদজাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকে, যাঁরা আমাকে মনোনয়ন দিয়ে ৫টি বছর এই সংসদে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। তাছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জ-১ এর নবীগঞ্জ ও বাহুবল উপজেলার সর্বস্তরের জনসাধারণকে। মাননীয় স্পীকার, ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরের বাজেটের আকার বিশাল ৪ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫ শত ৭৩ কোটি টাকা। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৯৩ হাজার ৭৮ কোটি টাকা বেশি। এই বাজেট নিয়ে অনেকে অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। নির্বাচনী বাজেট, গোষ্ঠীতন্ত্রের বাজেট, ঋণনির্ভর বাজেট, ব্যাংক মালিকদের পকেট ভারী করার বাজেট ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে মন্তব্য যেই যা করুক না কেন আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি এই বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন এই সরকারের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম “সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ।” বাজেটের শিরোনাম এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ১১০ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতা পাঠ করলে মনে হবে একজন সফল অর্থমন্ত্রীর নীরব আত্ম সমর্পন। গত ১০ বছরে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেট এবং তার বিভিন্ন মন্তব্য নিয়ে আমরা অনেক সমালোচনা করেছি। এমনকি আমরা তার পদত্যাগও দাবি করেছি। আমি আশা করেছিলাম, মাননীয় অর্থমন্ত্রীর শেষ বাজেট বক্তৃতায় তাঁর কিছু অনাকাড়িক্ষত ব্যর্থতার কথা উপস্থাপন করবেন। গতানুগতিক বাজেট বক্তৃতায় স্বভাবসূলভ অথবা মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি হয়তোবা কথাগুলো বলতে পারেননি। মাননীয় স্পীকার, যে কাজগুলো তিনি করতে পারেননি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংকিক খাতে লুটপাট বন্ধ করতে পারেননি, বরং ব্যাংক মালিকদের চাপের মুখে তিনি তাদের বিভিন্নভাবে সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছেন। অনেক আকাড়ক্ষা থাকা সত্বেও দশ বছরে জেলা বাজেট প্রণয়ন করতে পারেননি। সরকারের কোনো মেগা প্রকল্প এই সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ কারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেননি, এমনকি ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্টে শেয়ার বাজার কেলেংকারীদের নাম উঠে আসলেও তাদের নাম প্রকাশ করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। আমি জানিনা মাননীয় স্পীকার তাদের হাত কত লম্বা? মাননীয় অর্থমন্ত্রী কেন তাদের কাছে অসহায়? সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেননি প্রাইভেট-পাবলিক-পার্টনারশীপ প্রকল্প। এরপরেও আমরা কিভাবে বলবো, সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ। অথচ সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে আমরা দেখেছি মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার/ছয় হাজার কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৪ শত ৬০টি উপজেলা সৃষ্টি করে ঘুমন্ত গ্রামকে জাগ্রত করেছিলেন। শুরু করেছিলেন উন্নয়নের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। আমরা সত্যকে স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করি। মূলত এদেশে উন্নয়নের ইতিহাস রচনা করেন জনাব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ঢাকা শহরের এই সংসদ ভবনের সামনেও আমরা নৌকা চলতে দেখেছি। বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে ঢাকা শহরকে বন্যা নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছিলেন। অথচ একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যায়। কোন সরকার এই পর্যন্ত নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। মাননীয় স্পীকার, বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৮%। একজন সিনিয়র মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন বাজেট বাস্তবায়ন না হলে প্রবৃদ্ধি অর্জন কিভাবে সম্ভব? মাননীয় মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই, বাজেটের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও প্রবৃদ্ধির এই্ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। কারণ এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাজেটে কিছু শুভংকরের ফাঁকি আছে। এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ভর করে কয়েকটি সূচকের উপর। এর একটি সম্পর্কে আমি বলতে চাই, সেটি হলো মাথাপিছু আয়। যেমন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় দেখানো হয়েছে ১৭৫২ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ যদি আজকে ঔবভভ ইবুড়ং বা ইরষষ এধঃবং এর মতো একজনকে নাগরিকত্ব প্রদান করে তাহলে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। অর্থাৎ সূচক বেড়ে যাবে। তাতে একজন রিক্সাচালক বা চায়ের দোকানদারের আয়ের কি পরিবর্তন হবে? কোন পরিবর্তন হবে না। ফলে কাগজে কলমের হিসাব এবং বাস্তব এক নয়। এজন্য আমি বলছি জিডিপি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মাননীয় স্পীকার, বােেজটের সফলতা বলতে আমরা বুঝি বাজেটের বাস্তবায়ন, আর সাধারণ মানুষ বুঝো বাজেটে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লো না কমলো। জিনিসের দাম বাড়লে তারা মনে করে বাজেট ভালো না, আর দাম কমলে মনে করে বাজেট ভালো। তবে এবারের বাজেট নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন কোন আগ্রহ নেই। কারণ যে বাজেট মাননীয় অর্থমন্ত্রী জাতির কাছে উপস্থাপন করেছেন তাতে নতুনত্ব কিছু নেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষেত্র বিশেষে শুধু টাকার অংক পরিবর্তন করেছেন। এই বাজেট সম্পর্কে প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয়ভট্টাচার্য বলেছেন, চমকহীন স্থিতাবস্থার বাজেট। মাননীয় স্পীকার, আমরা যদি বাজেট বাস্তবায়নে পিছনের দিকে তাকাই তাহলে কি দেখতে পাই। বাজেট বাস্তবায়নই বর্তমানে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ২০১১-১২ অর্থবছরথেকে বাজেট বাস্তবায়নের হার ক্রমেই কমছে। ওই বছর বাজেটের ৯৩ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯১ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৮৫ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮২ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭৯ শতাংশ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হচ্ছে। তাহলে উন্নয়নের কোন মহাসড়কে বাংলাদেশ আমি বুঝতে পারিনা মাননীয় স্পীকার। মাননীয় স্পীকার, এডিপির বাস্তবায়নযদি আমরা লক্ষ্য করি, ৯০% থেকে ৯৫% কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন করে থাকি, বাস্তবে এটি অনেক কম। কারণ সব সময়ই আমরা দেখি বছরের প্রথম ৯/১০ মাসে ৫০%-৫৫% এর বেশি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি না। কিন্তু পরের ২/৩ মাসে বাস্তবায়নের গতি এতো বেড়ে যায় যে, এই সময়ের মধ্যে ৪০% থেকে ৪৫% বাস্তবায়ন হয়ে যায়। মূলত এই সময়ে এডিপির বাস্তবায়নের নামে চলে ব্যাপকভাবে লুটপাট। এটা আমরা সবাই জানি। এতো লুটপাটের পরেও চলতি বছরে বাজেট বাস্তবায়ন হবে ৯৬%। অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্বেও সরকার বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে এবারও ব্যাপক হারে লুটপাট হচ্ছে। এই বিশাল বাজেট সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন কোনভাবেই সম্ভব হবে না। মাননীয় স্পীকার, আমাদের অর্থনীতির দর্শন এমন মনে হয় যে, ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অবস্থা। সরকার যদি প্রস্তাবিত ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে যায়, যদিও তার সম্ভাবনা একেবারেই কম, সরকারকে ধার্যকৃত লক্ষ্যমাত্রার অধিক ঋণ নিতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় হওয়ার সম্ভাবনা একদিকে যেমন কম অন্যদিকে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রস্তাবিত ৫০ হাজার ১৬ কোটি টাকার ঋণ ও অনুদান সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেড়ে যাবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকিক খাত, যা আজ চরমভাবে বিপর্যস্ত। মাননীয় স্পীকার, প্রতিবছর বাজেটে ঘাটতি রাখা হয় জিডিপির ৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ সীমিত হয়ে পড়ে। অথচ দেখা যায় বাজেটে বরাদ্দ অর্থের সম্পূর্ণ অংশ বিভিন্ন কারণে ব্যয় করা সম্ভব হয় না, যা বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ কমায়। বাস্তবে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ৩ শতাংশের মতো। অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো খাতে যেখানে বিনিয়োগ করলে গুণগত প্রভাব তৈরি হয়, সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ কম রাখা হয়। দীর্ঘদন ধরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের বরাদ্দের তুলনায় অপরিবর্তিত রয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম সরকারের শেষ বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়বে এবং ননএমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্তকরণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকবে। কিন্তু বাজেটের কোথাও এ ব্যাপারে কোন আশ্বাস পাওয়া যায়নি। জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষকরা হতাশ, আমরা হতাশ, সমগ্র জাতি আজ হতাশ। শিক্ষাখাতে যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় শিক্ষার মান উন্নয়নের চেয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে লুটপাটকারীদের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। মাননীয় স্পীকার, এই বাজেটের আরেকটি দিক জাতিকে মারাত্মকভাবে হতাশ করেছে সেটি হলো এই বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কোন পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্ণর জনাব ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, বাজেটে কর্মসংস্থানের কোন নির্দেশনা নাই। গত বাজেটেও আমরা সেটি লক্ষ্য করেছি যে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতো হয়ই নাই বরং আরো কমেছে। মাননীয় স্পীকার, দেশে ১৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ তরুণ গ্রাজুয়েট হয়ে বের হচ্ছে, এদেরকে আমরা চাকরি দিতে পারছি না। এরা ইয়াবার দিকে যাচ্ছে, এরা মাদকাসক্তের দিকে যাচ্ছে, এরা জঙ্গিবাদের দিকে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদকে যদি কন্ট্রোল করতে হয়, ইয়াবাকে যদি কন্ট্রোল করতে হয়, অন্যান্য মাদক সেবন যদি কন্ট্রোল করতে হয়, বিপথগামী তরুণদের যদি সঠিক পথে আনতে হয়, হতাশার জন্য তারা এগুলো করছে, তাহলে আপনাকে চাকরির সংস্থান করতে হবে। মাননীয় স্পীকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘দিন বদলের সনদ’ এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেটের যে দর্শন তাতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পাবে। ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে এবং গরিব মানুষগুলোর জীবন-ধারন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। মাননীয় স্পীকার, আমরা এক সময়ে স্কুলে রচনা পড়তাম ইধপশ ঃড় ঃযব ঠরষষধমব, গ্রামে ফিরে যাও। এটা ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবের রাষ্ট্রদর্শন। তিনি বিশ্বাস করতেন উন্নয়নের সুষম বন্টন করতে হবে। গ্রাম এবং শহরের বৈষম্যদূর করতে হবে। দিন শুধু শহরে নয়, দিন গ্রামেও আছে। দিন বদলাতে হলে শহর এবং গ্রাম সবজায়গায়ই বদলাতে হবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবের রাষ্ট্রদর্শনকেই কাজে লাগাতে হবে। মাননীয় স্পীকার, আজকের ঢাকা শুধু বসবাসের অনুপযোগী নয়, বিষাক্ত। আজকে মানুষের ¯্রােত ঢাকাকেন্দ্রিক। প্রাদেশিক সরকার ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণ আজ সময়ের দাবি। আমার নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের কথা বলে আসছেন। অনতিবিলম্বে বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে ১৭ কোটি মানুষের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মাননীয় স্পীকার, আমাদের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে টিন নম্বর আছে মাত্র ৩৩ লাখ এবং এর মধ্যে অর্ধেক লোক আয়কর প্রদান করে। এই ব্যক্তিখাতে আয়কর নিয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী প্রতিবছর প্রায় একই ধরনের কথা বলছেন। কিন্তু কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। এবারও করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমাদের চবৎ ঈধঢ়রঃধ ওহপড় সবছিল ১৪৬৬ মার্কিন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চবৎ ঈধঢ়রঃধ ওহপড় সব ধরা হয়েছে ১৯৫৬ মার্কিন ডলার। চবৎ ঈধঢ়রঃধ ওহপড় সব প্রায় ৫০০ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পাওয়ার পরও মাননীয় অর্থমন্ত্রী আয়কর সীমা অপরিবর্তিত রাখার পিছনে যে যু্িক্ত উপস্থাপন করেছেন তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। আমি মনে করি করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি করে ৪ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা উচিত। মাননীয় স্পীকার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আহরিত রাজস্বের মধ্যে মূল্য সংযোজন করা বা ভ্যাট হচ্ছে অন্যতম। অথচ ১৯৯১ সাল থেকে অদ্যাবধি ভ্যাট নিয়ে ভাওতাবাজির শেষ নাই। প্রস্তাবিত বাজেটে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ভ্যাটের আওতা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করেছেন। একই পণ্য বড় শপিং মলে ভ্যাট দিয়ে ক্রেতাকে ক্রয় করতে হয়, আবার সাধারণ কোন দোকানে ভ্যাট ছাড়াই ক্রয় করা যায়। গ্রাহকের কাছ ভ্যাট আদায় করলেও তার ২০% এর বেশি সরকার আদায় করতে পারছে না, রাস্ট্রীয় কোষাগারে জমা হচ্ছে না। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর নাকের ডগা দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে, এটা আমরা সবাই জানি। মাননীয় অর্থমন্ত্রীও জানেন, কিন্তু কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণ বোধগম্য নয়। মাননীয় স্পীকার, বিশ্ব জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। এই বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ হচ্ছে লিডিং কান্ট্রি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে বিশ্ব জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। কিন্তু এই দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা কতটুকু প্রস্তত? আমরা কি দেখতে পাচ্ছি, জলবায়ু উন্নয়ন ফান্ড ট্রাস্টের অধীনে দেশি বিদেশি যে অর্থায়ন হচ্ছে সেখানে ব্যাপক লুটপাট হচ্ছে। এমনকি জলবায়ু উন্নয়ন ফান্ডের যে অর্থ ব্যাংকে ডিপোজিট করে রাখা হয়েছে সেখানে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। ব্যাংক সেই টাকা ফেরত দিতে পারছে না। সাধারণ মানুষ, ভুক্তভোগীরা তেমন কোন সুবিধা পাচ্ছে না। আজকে ভারত থেকে নেমে আসা পানি এবং পাহাড়ী ঢলে সিলেট এবং আমার নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জের নববীগঞ্জ এবং বাহুবল উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা মারাত্মকভাবে প্লাবিত হয়েছে। আমার হাওরবাসীরা অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছে। কিন্তু বিশ্ব জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় প্রশাসন যদি প্রস্তুত থাকতো তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। মানুষকে এমন দুর্ভোগের শিকার হতে হতো না। সরকারের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে বন্যার্ত এই মানুষগুলের জন্য ত্রাণসামগ্রী প্রেরণের আহ্বান জানাচ্ছি। মাননীয় স্পীকার, সামনে নির্বাচন। মানুষের মধ্যে অজানা আতংক। শেষ পর্যন্ত কি পরিস্থিতি তৈরি হয়। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে কি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচন বয়কট করলেও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যানবেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। আমরা যারা বিরোধীদলের সংসদ-সদস্য, জীবনের অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচন করেছি। সরকারকে দেশ পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছি। এই সরকারের ৫ বছরে আমার দল জাতীয় পার্টি অত্যন্ত সঠিক এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধদলের ভূমিকা কি হওয়া উচিত। মাননীয় স্পীকার, আমার নির্বাচনী এলাকা নবীগঞ্জ-বাহুবল একদিকেহাওর, বিল অন্যদিকে পাহাড়, চা বাগান এবং সমতল ভূমির এক নৈসর্গিক লীলাভূমি। কিন্তু উন্নয়ন এখানে মারাত্মক অবহেলিত। সরকারের শেষ সময়, এরপরে এতো সময় নিয়ে এই পার্লামেন্টে কথা বলার সুযোগ পাবো না। তাই আমার নির্বাচনী এলাকার দু’একটি বিষয় আপনার মাধ্যমে এই সংসদে উত্থাপন করতে চাই। তবে প্রথমেই বলতে চাই, বাজেট পাস হওয়ার পর বাজেটের অর্থ ছাড় করতে আগস্ট/সেপ্টেম্বর মাস চলে যায়। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নিজেদেরকে উন্নয়ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করার সুযোগ পাবো না। তাই মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, বাজেটের অর্থ দ্রুত ছাড় করার জন্য। মাননীয় স্পীকার, (১) আমার নির্বাচনী এলাকায় বিবিয়ানা গ্যাস অবস্থিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আমার নির্বাচনী এলাকায় বিবিয়ানা গ্যাস কুপে গিয়েছিলেন, সেখানে জনগণের পক্ষ থেকে আমার দাবির প্রেক্ষিতে বলেছিলেন যে এলাকায় গ্যাস পাওয়া যায় সেই এলাকার জন্য কিছু গ্যাস সংরক্ষিত থাকে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পার্লামেন্টে আমি দাবি জানিয়েছি। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আশেপাশে গ্যাস সংযোগ প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি। (২) মাননীয় স্পীকার, কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনে দীঘলবাক গ্রামটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বার বার আমি বিভিন্নভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করছি কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই গ্রামটি রক্ষা করার যথাযথ কোনো ব্যবস্থা এখনো গ্রহণ করা হয়নি। (৩) নবীগঞ্জ উপজেলার ১১নং গজনাইপুর ইউনিয়নের দেওপাড়া-শতক রাস্তাটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ। রাস্তাটি সংস্কারের জন্য মাননীয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি। ১৩নং ইউনিয়নের বিশ্বরোড থেকে বরচর রাস্তা এবং ২নং ইউনিয়নের কাজীর বাজার থেকে কাজীরগাঁও রাস্তা দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে রাস্তা দুটি পাকা করা একান্ত আবশ্যক। (৪) বাহুবল উপজেলার মিরপুর ইউনিয়নের লাকড়িপাড়ায় খোয়াই নদীর উপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করা অত্যাবশ্যক। তছাড়া বুগলি থেকে লাকড়িপাড়া রাস্তা পাকাকরণের জোর দাবি জানাচ্ছি। (৫) আমার নির্বাচনী এলাকার কৃতি সন্তান দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ছিলেন, তিনবার এমপি ছিলেন, জনাব শাহ এএমএস কিবরিয়া সাহেব অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তারা কিছু রাস্তাঘাটের উন্নয়নের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারেননি। আউশকান্দি হতে হবিগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তাটি প্রসস্ত করে জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন। (৬) অনেক উপজেলায় মিনি স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও আমার নবীগঞ্জ উপজেলায় এখনো মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নবীগঞ্জ উপজেলার চৌশতপুর গ্রামে একটি মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ করার জোর দাবি জানাচ্ছি। এ বিষয়ে আমি মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বরাবর ডিও লেটারও দিয়েছি। (৭) মাননীয় স্পীকার, আমার নবীগঞ্জ থানায় একটি পিকআপ ভ্যান দরকার। আমি অনেক বার এই সংসদে বলে আসছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক মানের ফাইভ স্টার হোটেল আমার নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত। প্রতিদিন এখানে ভিআইপিরা যাতায়াত করেন। মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এখানে নাই। তিনি আমাকে বলেছিলেন একটি গাড়ি দিয়ে দিবেন। কিন্তু এখনো সেটি পাওয়া যায় নাই। কিন্তু এখনো সেটি পাওয়া যায় নাই। আমি অনুরোধ করছি জরুরি ভিত্তিতে একটি গাড়ি দেয়ার জন্য। (৮) মাননীয় স্পীকার, শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। অথচ আমার নবীগঞ্জ উপজেলার হৈবতপুর, পূর্ব কসবা, চাতল গ্রাম, বাহুবল উপজেলার রূপাইচড়া ভবানী গ্রামে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নাই। এই গ্রামগুলিতে জরুরি ভিত্তিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জোর দাবি জানাচ্ছি। (৯) মাননীয় স্পীকার, আমার নবীগঞ্জ উপজেলার ১০নং ইউনিয়নের ইমামগঞ্জ ও ইসলামপুর গোপলার নদীর উপর ব্রীজ নির্মাণের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। তাছাড়া আরো কয়েকটি ছোট ছোট কয়েকটি ব্রীজ নির্মাণ করা অতীব প্রয়োজন। সর্বশেষ এই পার্লামেন্টের সকল সদস্য এবং আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।


     এই বিভাগের আরো খবর