,

বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা ও আমাদের দায়িত্ব

মো: জসীম উদ্দিন
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বাহুবল।

শিক্ষার প্রথম কাজ হলো কৌতুহলের শিকে ছেঁড়া। আরো বলা যায়, শিক্ষা হলো সভ্যতার রূপায়ন। শিক্ষা নিয়ে যথাক্রমে আইভরি ব্রাউন ও এরিয়াল ডুরান্ট এর উক্তি দুটো একেবারেই যথাথর্থ। আমি একজন শিক্ষিত মানুষ ও নিরক্ষর মানুষের তফাৎ দেখেছি। শিক্ষিত মানুষটি জিজ্ঞাসু, জ্ঞানপিপাস, অনুসন্ধিৎসু, ও চিন্তা-চেতনায় প্রসারিত। আর নিরক্ষর মানুষটি নিশ্চুপ, সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে সভ্যতা হচ্ছে উন্নত রুচি-মানসিকতা, চলনে বলনে সমৃদ্ধ, কৃষ্টি কালচারে আধুনিকতায় উচ্চসিত, যা আমরা মানব সভ্যতার উত্তানে দেখি মূলত শিক্ষার তেলেসমাতিতে। আমরা শিক্ষিত জাতি, এটি আমরা দাড়ি কমা দিয়ে হলেও এখন বলতে পারি। আমাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। একটি সুউচ্চ ইমারতের পূর্বশর্ত শক্ত ভিত। ভিতে গন্ডগোল হলে ইমারত ভেঙ্গে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এ জন্যই আমরা প্রাথমিক শিক্ষাকে বলতে পারি ফাউন্ডেশন শিক্ষা এবং এর গুরুত্ব অত্যধিক। বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার আনুষ্ঠানিক প্রচলন কখন কোথায় হয় বলা কঠিন। ঋগবেদ রচিত হওয়ার কালে অর্থাৎ আনুমানিক ৩০০০ বছর পূর্বে এ উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বীজ রূপিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় উপনিত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার ঐতিহাসিক পটভুমি বিশ্লেষনে প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ, উপনিবেশিক যুগ, ১৯৪৭ পরবর্তী পর্যায় ও বাংলাদেশ আমল পাওয়া যায়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৭০০০ যা পরবর্তীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জাতীয়করণ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫,০৯৯টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের অর্জিত এমডিজিতে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং এসডিজিতে গুনগত শিক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। সরকার সবার জন্য মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে বহুমুখি পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। তন্মধ্যে শিক্ষার বাজেট বাড়ানো, নতুন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটালাইজড শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করন, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, প্রায় ২৬,০০০ রেজিস্ট্রার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরন, শিক্ষদের শূন্য পদ পূরন, পাঠ সহায়িকা প্রস্তুত-বিতরণ, ০১ জানুয়ারীর মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি বিশেষ করে নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠির জন্য আলঅদা শিক্ষা বাজেট, বিদ্যালয় বিহীন গ্রামে বিদ্যালয় নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ, শিক্ষদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থেদের উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ-মাল্টিমিডিয়া বিতরণ, শিক্ষকদের বাড়ির কাছাকাছি পদায়ন, স্থানীয় বরাদ্ধ বৃদ্ধি, শ্রেষ্ঠ দক্ষ শিক্ষক স্বীকৃতি, বিদেশ টুর ইত্যাদি নানামুখী প্রশংসনীয় উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা নি:সন্দেহে আগের চেয়ে অনেকগুন এগিয়েছে। কিন্তু এখনও কী আমরা সরকারের উদ্যোগের সাথে সামনজাস্য রেখে কাড়িখত মাত্রায় যেতে পেরেছি? প্রকৃত অর্থে কোথায় আমদের দূর্বলতা তা খুজে বের করা প্রয়োজন। আমার অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধানে যে বিষয়টি উপলব্ধি করেছি তা হলো আমাদের দায়িত্ববোধের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, অভাব রয়েছে আমাদের আন্তরিকতার। মাঠ প্রাথমিক শিক্ষার সূচারু বাস্তবায়নে যারা স্টেকহোল্ডার তারা হলেন স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা অফিস, এসএমসির সদন্যবৃন্দ, শিক্ষকবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি-সাংবাদিক ও অভিভাবকবৃন্দ। প্রাথমিক শিক্ষার সুচারু মনিটরিং, সমন্বয় সাধন, স্থানীয় উদ্যোগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চিত করন, উদ্বুদ্ব করণ ও কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন স্থানীয় প্রশাসনের মূল দায়িত্ব। নিবিড় মনিটরিং, সরকারী নির্দেশনা বাস্তবায়ন, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করনে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিটি ধাপ পর্যবেক্ষন, রেকর্ড সংরক্ষণ, অভিভাবক সমাবেশ, এসএমসির সদস্যদের নিয়ে সভা করা, সমস্যা নিরূপন-সমাধান, শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে যথাযথ রিপোটিং করা শিক্ষা অফিসের দায়িত্ব। এসএমসির সদস্যবৃন্দ সরাসরি শিক্ষকদের কাযক্রর্ম, পাঠদান ও ছাত্র উপস্থিতির বিষয় খেয়াল রাখবে। ছোটখাট সমস্যার সমাধান করে স্কুলের সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে ভূমিকা পালন করবেন। নিয়ম-কানুন ও দায়িত্বের ব্যত্যয় হলে উর্দ্ধতন কর্ত”পক্ষকে জানাবেন। প্রাথমিক শিক্ষার ব্যর্থতা ও সফলতা বেশীর ভাগটাই নির্ভর করে শিক্ষকদের উপর। তারা যদি শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানতুল্য মনে করে সর্বোচ্ছ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে আগামী প্রজন্মকে নিয়ে সঠিক স্বপ্ন বুনে তাহলে সবই হয়, কিঞ্চিত বাকি থাকে আমদের জন্য। জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক যার যার অবস্থান থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারেন। জনপ্রতিনিধিরা প্রতিনিয়িত জনগনের সংষ্পর্শে থাকতে পছন্দ করেন, গুরে বেড়ায় মানুষের মাঝে। তারা স্কুল পরিদর্শণ ও স্থানীয় বরাদ্ধ প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারে। আর সংবাদিকগণ সমাজের দর্পন হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার ভাল মন্দ সঠিকভাবে তুলে ধরলে সবাই আরো দায়িত্বশীল হবে। অভিভাবকগণ শুধু তার সন্তানকে কাসে র্ফাস্ট বানাতে ব্যস্ত থাকেন। সন্তানের অন্যান্য দিক যেমন-দেশপ্রেম, মনুষত্ব, নৈতিকতা, ধর্মীয় শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ, শৃংখলা ইত্যাদিতে মনযোগ দেয়না। এর ব্যতিক্রম প্রয়োজন। তাছাড়া তারা শিক্ষকদের অবস্থায় নেয় না এবং যথাযথ সম্মান দেয়না। এটিরও ব্যতিক্রম প্রয়োজন। আরো অনেক কিছু বলার ছিল, থাক, শুধু এটুকু বলে শেষ করছি—সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি এদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে আমাদের আরো আন্তরিক, দায়িত্বশীল ও যতœশীল হওয়া প্রয়োজন।


     এই বিভাগের আরো খবর