,

বনানীতে আগুনে নিহত ২৫ মৃত্যুফাঁদে বাঁচার লড়াই

সময় ডেস্ক ॥ বাইশ তলা ভবনে হাজারো মানুষের কর্মস্থল। দুপুরের খাবারের আগে সবাই ছিলেন কাজে ব্যস্ত। হঠাৎই খবর আগুন লাগার। প্রাণে বাঁচতে যে যেভাবে পারেন নিচে নামার চেষ্টা। আগুনের লেলিহান শিখা আর ধোঁয়ার কুন্ডলীর কারণে ভবনে আটকা পড়েন অনেকে। কেউ লাফ দেন। কেউ পাইপ বেয়ে নামার চেষ্টা করেন। ভবনে আটকে পড়াদের বাঁচার আকুতি। জীবন-মৃত্যুর মাঝ  থেকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা। ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় পর যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে তখন অনেকটা ভস্মীভূত সুউচ্চ ভবনটি। আগুন নেভানোর আগেই লাফিয়ে পড়ে ও আগুনে পুড়ে মারা যান সাতজন। আগুন নেভানোর পর ভবন থেকে বের করে আনা হয় একের পর এক লাশ। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভবন থেকে ১২ জনের মৃতদেহ নামিয়ে আনা হয়। মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫-এ । নিহতদের মধ্যে একজন শ্রীলঙ্কান নাগরিকও আছেন। উদ্ধারকারীরা তখনও উদ্ধারকাজ করছিলেন। ভেতরে আরো লাশ আছে কিনা তা তল্লাশি করছিলেন উদ্ধার সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর বনানীর বহুতল ফারুক রূপায়ণ (এফআর) টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দিনভর এই ভবনের অগ্নিকান্ড নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল  দেশজুড়ে। দুপুরে অগ্নিকান্ডের পর তা ছড়িয়ে পড়ছিলো ভবনের বিভিন্ন তলায়। নিরুপায় হয়ে চিৎকার করে, জানালা দিয়ে হাত নেড়ে সহযোগিতা চেয়েছিলেন শত শত মানুষ। ফোনে স্বজনদের জানিয়েছেন বাঁচার আকুতি। তাদের অনেককেই উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ১৭ নম্বর রোডের ২২ তলা ভবনে আগুন লাগে। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। একে একে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট।  দীর্ঘক্ষণ কাজ করার পর বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে ও উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করেন সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। এ ছাড়া রেড ক্রিসেন্ট ও রোভার স্কাউটের সদস্যরাও সহযোগিতা করেন। ধারণা করা হচ্ছে, ৮তলা থেকেই আগুনের উৎপত্তি। এসময় নিচের ফ্লোরগুলোর মানুষ বের হতে পারলেও উপরের ফ্লোরগুলোর তেমন কেউ বের হতে পারেন নি। তাদের মধ্যে একজন জাহাঙ্গীর আলম। ওই ভবনের চিলেকোঠায় ছিলেন তিনি। হঠাৎ ধোঁয়া দেখতে পান। সঙ্গে মানুষের চিৎকার কানে ভেসে আসছিলো। তখন অনেকেই সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু নবম তলায় পৌঁছেই তীব্র গরম অনুভব করেন। নিচতলায় যাওয়া সম্ভব না ভেবেই আবার ছাদে যান। জাহাঙ্গীর জানান, তখন বারবার চুড়িহাট্টার আগুনের কথা মনে পড়ছিলো। তিনি দোয়া পড়ছিলেন। ছাদ থেকে পাশের ভবনের ছাদে চলে যান। জাহাঙ্গীর জানান, ঝুঁকি নিয়েই লাফ দিয়ে ওই ছাদে যান তিনি। তারপর ওই ভবনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামেন। শুরুতে অনেকেই লিফট দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। আবার অনেকে লাফ দিয়ে নিহত হন। অনেকে গুরুতর আহত হন।  ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তিনটি লেডার দিয়ে ভবনের ১৮তলা পর্যন্ত পানি দিচ্ছিলেন। উদ্ধার করা হয়েছে ১৪ তলা পর্যন্ত অবস্থানকারীদের। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, লেডার দিয়ে ২০ তলা পর্যন্ত অগ্নিনির্বাপণের কাজ করা সম্ভব। তবে উদ্ধার কাজ করা যায় ১৮ তলা পর্যন্ত। এফআর টাওয়ারে তিনটি লেডার সার্বক্ষণিক কাজ করেছে। এ ছাড়াও আরো ছোট আকারের আরো দুটি লেডার ছিল।
আগুন লাগার খবর পেয়ে ভবনে আটকে পড়াদের স্বজনরা বনানীর কামাল আতার্তুক এভিনিউয়ে ভিড় করেন। ভবনের আগুন ও ধোঁয়া দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। অনেকেই হাত উঁচিয়ে স্বজনদের জীবিত ফিরে পেতে দুই হাত তোলে দোয়া করছিলেন। ‘আল্লাহ আল্লাহ’ ধ্বনি শোনা গেছে তখন অনেকের মুখে। ফোনে আটকে পড়াদের ছাদে যেতে পরামর্শ দিচ্ছিলেন স্বজনরা। তারা বলছিলেন, ছাদ থেকে হেলিকপ্টার তাদের উদ্ধার করবে। আগুন নেভাতে সহযোগিতা করতে আশেপাশে উড়ছিলো সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারও। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ জানান, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী এই উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়েছে। জানা গেছে, বনানীর এই ২২ তলা বিশিষ্ট টাওয়ারে  অন্তত ২৫টি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিন গতকাল ওই টাওয়ারে সহস্রাধিক লোক ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই টাওয়ারের দু’তলায় রয়েছে হাব বনানী রেস্টুরেন্ট, কিন্ডারড ক্যাফে অ্যান্ড বেকারি, আইএফআইসি ব্যাংক, ভিভিড হলিডে লিমিটেড, আট তলায় স্পেক্টা, নয় তলায় এম্পায়ার গ্রুপের অফিস, ১০ তলায় আমরা টেকনোলোজিস, ১২ তলায় ডার্ট গ্রুপের অফিস, ইএউআর সার্ভিস, ১৬ তলায় মিকা সিকিউরিটিজ, ১৯ তলায় আমরা আউটসোর্সিং, ২০ তলায় দ্য অয়েভ, ম্যাগনিটো ডিজিটাল, ২০ তলায় কাসেম গ্রুপের অফিস। ২১, ২২ ও ২৩ তলায় কাসেম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই ভবনে রয়েছে তিনটি লিফট। দুটি সিঁড়ি। সঙ্গে স্থানীয় লোকজনও সহযোগিতা করেন। তবে উৎসুক মানুষের ভিড় উদ্ধার কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। অগ্নিকান্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সপ্তম থেকে দশম তলা। ওই চারটি ফ্লোরে বিভিন্ন অফিসে সোফাসহ আসবাবপত্র থাকায় প্রচুর ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। তাতে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পানি দিয়ে আগুন একটু নিয়ন্ত্রণে আনার পর পরই আবার আগুন জ্বলতে দেখা যায়। জীবন বাঁচাতে অনেকে ভবনের ছাদে বা উপরের তলাগুলোতে উঠে যান। তাদের কেউ কেউ জানালার কাচ ভেঙে হাত নেড়ে বাঁচার আকুতি জানান। এরই মধ্যে বাঁচার জন্য মরিয়া চেষ্টায় বিভিন্ন ফ্লোর থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে গুরুতর আহত বা নিহত হন বেশ কয়েকজন। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা আর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা চিৎকার করে নিষেধ করেও তাদের থামাতে পারেননি। আটকে পড়াদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা শান্ত থাকতে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তাদের জন্য নিচ থেকে ভেজা তোয়ালেও কাপড় দেয়া হচ্ছিল। ধোঁয়ার জন্য লেডার উপরে না যাওয়ায় তাদের নামাতে বেগ পেতে হয়। একপর্যায়ে এফআর টাওয়ারের একপাশের আহমেদ টাওয়ার এবং অন্য পাশের আওয়াল সেন্টারেও আগুন ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক দেখা দেয়। দুই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা বাসিন্দারাও ততক্ষণে বেরিয়ে আসেন। ওই দুই ভবনে থাকা দুরন্ত টিভি ও রেডিও টুডের সরাসরি সমপ্রচারও সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। সর্বশেষ ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আহত অবস্থায় নেয়া হয় ৪ জনকে,  এর মধ্যে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন ২ জনকে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আহত অবস্থায় নেয়া হয় ৪২ জনকে, এর মধ্যে এক শ্রীলংকার নাগরিককে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ছাড়া ইউনাইটেড হাসপাতালে আহত অবস্থায় নেয়া হয় ৫ জনকে,  এর মধ্যে মৃত ঘোষণা করা হয় ৩ জনকে। ফায়ার সার্ভিসের দেয়া হিসাব অনুযায়ী মোট নিহতের সংখ্যা ২৫ জন। এ ছাড়া চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরো ৭০ জন। অন্যদিকে, হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, অ্যাপোলো হাসপাতালে মারা গেছেন আমেনা নামের এক নারী। এ ছাড়া বনানী ক্লিনিকে মারা গেছেন পারভেজ সাজ্জাদ নামের একজন। এদিকে আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনের ভিতরে প্রবেশ করেন। তারা বিভিন্ন তলায় তল্লাশি চালিয়ে একের পর এক বের করে আনে লাশ। লাশগুলো উদ্ধার করে নেয়া হয় হাসপাতাল মর্গে। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উদ্ধার কাজ চলছিল। নিচে অপেক্ষা করছিলেন নিখোঁজ মানুষদের স্বজনেরা। এদিকে আগুনের ঘটনায় হতাহতে শোক প্রকাশ প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ঘটনাস্থলে ছুটে যান ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান খান কামালসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।


     এই বিভাগের আরো খবর