,

আজ পহেলা বৈশাখ

সময় ডেস্ক ॥ ‘নিশি অবসান প্রায় ঐ পুরাতন বর্ষ হয় গত/আমি আজি ধূলিতলে জীর্ণ জীবন করিলাম নত/বন্ধু হও শত্রু হও যেখানে যে রও, ক্ষমা কর আজিকার মত/পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত।’ আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্দা উঠবে নতুন বঙ্গাব্দের। চৈত্রসংক্রান্তির মাধ্যমে গতকাল ১৪২৫ সনকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ যুক্ত হয়েছে নতুন বছর ১৪২৬। স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিয়েছে   ঘটনাবহুল ১৪২৫। জীর্ণ-পুরাতনকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করেছে বাঙালি জাতি। ব্যতিক্রমহীনভাবেই কবিগুরুর গানে নতুন বছরকে জানানো হবে আহ্বান। অনেকটা প্রার্থনাসংগীতের মতোই জরা ও গ্লানির পুরাতন মুছে ঘোষিত হবে মঙ্গলময় আগামী নির্মাণের প্রত্যয়। রমনার বটমূলে ছায়ানটের আয়োজন আর মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আজ ১৪২৬ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানানো হবে। শুভ বাংলা নববর্ষ, স্বাগত অভিবাদন। নববর্ষ আসে নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যয় নিয়ে। সব অশুভ ও অসুন্দরকে পেছনে ফেলে নতুন কেতন উড়িয়ে বৈশাখ আসে। বিপুল বৈভব, সম্ভাবনা, নতুনের আহ্বান, পুরাতন দিনের হতাশা কাটিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবে আজ বাঙালি। পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মাতবে দেশ। স্নাত হই বৈশাখের রৌদ্র খরতাপে, দূর করি বৎসরের যত আবর্জনা। গ্লানি মুছিয়ে, জরা ঘুচিয়ে শপথ নিই বিশুদ্ধতার। নতুন বছরে সবার আশা এক বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। যেখানে থাকবে না কোনো ভয়, হতাশা কিংবা অশুভ শক্তির। গণমানুষের অধিকার আদায় আর শান্তি-স্বস্তির স্মারক হয়ে উঠুক আজ। হাজার বছরের বয়ে চলা লোকজ সংস্কৃতি আমাদের নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে। নতুন বছরের নতুন সূর্যোদয়ে নতুন কুঁড়ির মতো আমাদের সমাজ, জীবনে এবং রাষ্ট্রে সম্ভাবনার নতুন নতুন পালক যুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা গণমানুষের। বিশ্বকবির ভাষায়, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ পহেলা বৈশাখে আমরা সুন্দর, সুচি আর চিরমঙ্গলের জয়গান করি। পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এ উৎসবের সার্বজনীনতা অসাধারণ। বাঙালি জাতি তার নববর্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে চলেছে, আর এ ধারা চলে আসছে গানে-কবিতায়, লোকাচারের নানা অনুষঙ্গে, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। দেশের বৃহত্তম অসামপ্রদায়িক উৎসব হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে বাংলা নববর্ষ বহুকাল ধরে বরণীয়। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের সঙ্গে বাংলার সাহিত্য, বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কও তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই বাংলা সন গণনার শুরু মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসন ভিত্তি করে প্রবর্তন হয় নতুন এই বাংলা সন। পরে যুক্ত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। অমর্ত্য সেন তার আর্গুুমেন্টিভ ইন্ডিয়ানে বলেছেন- ‘আকবর সব ধর্মবিশ্বাসীর সমান উপযোগী একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে চেয়েছিলেন।’ আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল ‘আকবরনামা’য় লিখেছেন-  ‘ফসল সংগৃহীত হয় সৌর বর্ষপঞ্জি অনুসারে। তাই হিজরি সালের পাশাপাশি একটি সৌর বর্ষপঞ্জির প্রয়োজন ছিল। দ্বীন-এ-ইলাহির মতো আকবর সেটির নাম দিয়েছিলেন তারিখ-ই-ইলাহি।  বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ সালে। নক্ষত্রের নাম থেকে নেয়া হয় মাসগুলোর নাম। তারিখ-ই-ইলাহি চালুর পর ১৪টি নতুন উৎসবের কথা ঘোষণা করেন আকবর। এই রকম এক নওরোজেই শাহজাদা খুররমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল মমতাজের। এ কারণে অনেকে বলতে চান, পহেলা বৈশাখ না হলে সৃষ্টি হতো না প্রেমের অমর স্মৃতি তাজমহল। বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। পয়লা বৈশাখ এখন সব বাঙালির সার্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সমপ্রদায়নির্বিশেষে বাংলা ভূখন্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব। কৃষকসমাজ আজও অনুসরণ করছে বাংলা বর্ষপঞ্জি। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও পরে সংযোগ ঘটে রাজনৈতিক ইতিহাসের। আমাদের পরাধীনতার কালে এই উৎসব আয়োজনে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাঙালিও সোচ্চার ছিল প্রতিবাদে। ষাটের দশকে রমনা বটমূলে সূচিত ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির আত্মপরিচয়ের আন্দোলন-সংগ্রামকে করেছে বেগবান। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্ব্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর ইউনেসকো এ শোভাযাত্রাকে দিয়েছে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা। প্রথমদিকে পয়লা বৈশাখের উৎসব ছিল মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। শহরে-বন্দরেও তা সীমিত ছিল হালখাতায়। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে বর্ণিল, বর্ণাঢ্য আয়োজনে এ উৎসব পালিত হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি নগর-মহানগরে। ঢাকায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আদলে প্রায় সর্বত্র আয়োজিত হয় এ অনুষ্ঠান। বাংলা নববর্ষে ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’ রীতি এখনো এ দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির আমেজ নিয়ে উৎসবের পরিধির বিস্তার ঘটিয়েছে। আধুনিক বাঙালি তাদের বাংলা নববর্ষকে সাজিয়ে তুলছে মাতৃভূমির প্রতিটি আঙিনায় আরো বেশি উজ্জ্বলতায়। দেশের পথেঘাটে, মাঠে-মেলায়, অনুষ্ঠানে থাকবে কোটি মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য, আর উৎসবমুখরতার বিহ্বলতা। পয়লা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারা দেশ। বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। সর্বত্র দেখা যায় নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস। কবির ভাষায়- ‘অনাগত আগামীর অফুরান বাদ্য/নতুনের আবাহনে হয়’।


     এই বিভাগের আরো খবর