,

বাড়ছে ইন্টারনেটে আসক্তি, চিকিৎসায় বিএসএমএমইউতে বিশেষ ব্যবস্থা

সময় ডেস্ক ॥ সুজিতের বয়স ১৮ বছর। থাকেন রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায়। ঢাকার একটি নামকরা স্কুল থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মেডিকেল কোচিং করছেন। নামে মাত্র কোচিং করলেও পড়ালেখার ধারে কাছেও নেই। ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৬ ঘন্টাই ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। রাত দিন তার কাছে সমান। নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। রাতে ঘুমায় মাত্র ৪ থেকে ৫ ঘন্টা। সারাক্ষণ ইন্টারনেটে বিজি থাকতে না পারলে যেন প্রাণটা বেড়িয়ে যায়। মোবাইল ফোনে গেম খেলা, কার্টুন দেখা, মুভি দেখা এটাই তার দৈনন্দিন রুটিন। সম্প্রতি তার মেজাজ বড্ড খিটমিটে হয়ে গেছে। কারো কথাই সহ্য হয় না। অল্পতেই রেগে যায়। অথচ কিছুদিন বাদেই তার পরীক্ষা। এ বিষয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। অবশেষে, তার মা বাধ্য হয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। ডাক্তারের ফলোআপে থেকে এখন ১৬ ঘন্টা থেকে ১০ ঘন্টায় তার আসক্তি কমিয়ে এনেছে। রোহান বড্ড শান্ত স্বভাবের। বয়স ১৬ বছর। হঠাৎ করে ইন্টারনেট আসক্তে জড়িয়ে পড়ে। সারাক্ষণ নিজের রুমের দড়জা বন্ধ করে মোবাইল ফোনে কি যেন একটা করে। জানেনা তার বাবা-মা। দৈনিক কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা সময় ব্যয় করে ইন্টারনেটে। রুমের দড়জা খুলতে বললেই যেন তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। সারাক্ষণ লুকিয়ে কি যেন একটা দেখে। কিন্তু বাবা মা‘কে সে কিছু বলে না। পরবর্তীতে জানিয়েছে শুধুমাত্র কার্টুন, ইউটিউব আর গেম খেলে। কিন্তু তার আচরণের ভেতর কি যেন এক রহস্য লুকিয়ে আছে। দড়জা খুলে ওয়াইফাই বা ইন্টারনেট ব্যবহারে তার সমস্যা কোথায়? বাবা-মা ও চিকিৎসকদের ধারনা সে হয়তো লুকিয়ে পর্নো সাইটগুলোতে আনাগোনা করে। পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়া কোনোটাই যেন ঠিক নেই। ইন্টারনেটের নেশায় সারাক্ষণ বুদ হয়ে থাকে। ২৫ বছরের যুবক আয়ান। সদ্য বিয়ে করেছে। বলতে গেলে তেমন কিছুর অভাব নেই তার। নিজের স্ত্রী পাশে থাকা স্বত্বেও বিভিন্ন পর্নো সাইট দেখা তার নেশা। স্ত্রীকে বাদ দিয়ে পর্নো সাইটের রঙ্গীন জগতের নারীদের কল্পনা করতেই যেন সে বেশি সাচ্ছন্দবোধ করে। কিন্তু সম্প্রতি এটা নিয়ে দেখা দিয়েছে তার শারীরিক বিপত্তি। পাশাপাশি সাংসারিক টুকিটাকি কলহতো লেগেই আছে। নিজের স্ত্রীর কাছে যদিও পর্নো দেখার বিষয়টি শেয়ার করেন নি আয়ান। অবশেষে বাধ্য হয়ে ডি-এডিকশন ক্লিনিকের শরণাপন্ন হয় আয়ান। ইন্টারনেট আসক্তির ব্যাপারটা প্রথমবারের মতো মনোবিজ্ঞানীদের নজরে আসে ১৯৯৭ সালে সিনসিনাটি কেইস-এর মাধ্যমে। সান্দ্রা হ্যাকার নামে একজন মহিলা তার তিনটি শিশু সন্তানকে অবহেলা করে ও নিজর্ন কামরায় আবদ্ধ রেখে দৈনিক ১২ ঘন্টারও বেশি সময় ইন্টারনেটে অতিবাহিত করতেন। এই মহিলাকে পর্যবেক্ষণ করে মনোবিজ্ঞানীদের অনেকেই সম্মত হলেন যে সিগারেট, মদ ও ড্রাগের মতো ইন্টারনেটেরও কম্পালসিভ (বাধ্যকারী) ক্ষমতা আছে অর্থাৎ যা একটি পর্যায়ে এসে মানুষ ইচ্ছার বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। সেই ধারণা থেকেই ‘ইন্টারনেট অ্যাডিকশন’ কথাটির সৃষ্টি। বর্তমান সময়ের প্রযুক্তি নির্ভর যুগে, সনাতন মাদক দ্রব্য ছাড়াও নতুন ধরনের আসক্তি সমাজকে গ্রাস করছে। এর মধ্যে ইন্টারনেট অ্যাডিকশন অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি ‘‘গেমিং ডিজওর্ডার’’ কে মানসিক রোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ডি এডিকশন ক্লিনিক আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের যাত্রা শুরু করে। এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের বহির্বিভাগের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের একটি অংশ। বিএসএমএমইউ হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ হাসপাতালের ই ব্লকের ৬ষ্ঠতলায় ৬০৮ নম্বর কক্ষে প্রতি সোমবার ‘ডিঅ্যাডিকশন ক্লিনিকের’ আওতায় রোগীদের চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং করে থাকে। দেড় বছর ধরে হাসপাতালে এই সেবা দেয়া হচ্ছে। বলতে গেলে একদম বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় এখানে। এক্ষেত্রে বহির্বিভাগ থেকে মাত্র ৩০ টাকায় টিকিট কেটে যে কেউ এ সেবা নিতে পারেন। তবে, এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে বয়স্কদের থেকে কমবয়সী রোগীদের সংখ্যাই তুলনামূলকভাবে বেশি।সমাজবিজ্ঞানি নেহাল করিম বলেন, এখন পৃথিবীব্যাপি বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে। এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ভালোমন্দ ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেক বিষয় আসে। এরমধ্যে থেকে আমরা কোনটা নেব আর নেবো না সেটা আমাদের ব্যক্তিগত রুচির ওপর নির্ভর করছে। শিশু কিশোরদের ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বের করে আনতে হলে তাদের মধ্যে ভালো এবং মন্দ এই বোধ শক্তিটাকে জাগাতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিকতা সংক্রান্ত মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। এর মাধ্যমে বোধশক্তিকে জাগ্রত করে এটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। মূল সমস্যা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে মূল্যবোধের চর্চাটা হয় না। খেলার মাঠ নেই বলেই এখনকার বাচ্চারা ইন্টারনেট নিয়ে পরে থাকে। শিশুদের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা নেই বলে এখন বাসা বাড়ির মধ্যে স্কুল তৈরি করা হয়। ছোট্ট একটু গন্ডির মধ্যে তাদের আবদ্ধ করে রাখা হয়।


     এই বিভাগের আরো খবর