,

‘চীনে নিঃশ্বাস নিতে ভয় করতো’

সংবাদদাতা ॥ ‘চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ার পর নিঃশ্বাস নিতে ভয় করতো আমাদের। বার বার মনে হতো যদি নিঃশ্বাসে ভাইরাস ঢুকে যায়। তাই ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর বিমানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাস্ক খুলে আগে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছি আমরা।’- কথাগুলো বলছিলেন আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন চীনের জিয়াংসু প্রদেশ থেকে দেশে ফেরা হবিগঞ্জের ২ শিক্ষার্থী আরিফ এবং আরাফাত। জিয়াংসু প্রদেশে কাটানো দুর্বিসহ দিনগুলোর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তারা বলেন, গত প্রায় দেড়মাস আমরা যে কতটা আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। একদিকে চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে একের পর এক শহর লক ডাউন হচ্ছে। অপরদিকে পরিবারের মানুষজনকে বলতে পারছিলাম না। কারণ তারা দুশ্চিন্তা করবেন। সব মিলিয়ে খুবই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। চীন থেকে দেশে ফেরা হবিগঞ্জের আরিফ, রিফাত, খলিল, সুহেল, মাহিন, আদনান, আকাশ, অমল, জাকির, সনি একই কলেজে পড়ার সুবাদে এক সঙ্গেই থাকতেন। তাই প্রায় দেড়মাস চীনের দুর্বিসহ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা সবার প্রায় একই। দেশে ফেরার পর ফোনে এই প্রতিবেদকের কথা হয় তাদের সাথে। জানা যায়, চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জিয়াংসু ভোকেশনাল কলেজ অব এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রিতে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিল হবিগঞ্জের ১২ জন শিক্ষার্থী। ওই দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ার গত ৩ ফেব্রুয়ারি জিয়াংসু প্রদেশ থেকে দেশে ফিরেন বাংলাদেশের ১৫ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে হবিগঞ্জের ১০ শিক্ষার্থী ছিলেন। জিয়াংসু প্রদেশে অধ্যয়নরত হবিগঞ্জের বাকী ২ জন শিক্ষার্থী আর্থিক সমস্যার কারণে আসতে পারেনি। শিক্ষার্থীরা জানান, গত ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে তারা করোনাভাইরাসের কথা শুনতে পান। তখনও ভাইরাসটি এতটা বিস্তার লাভ করেনি চীনে। তারপরও এই ভাইরাসের কথা শোনার পর থেকেই তারা আতঙ্কিত ছিলেন। ২০ জানুয়ারিতে তারা শুনতে পান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কথা। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কমিউনিটি গ্রুপগুলোর মাধ্যমে তারা জানতে পারেন এই ভাইরাসে সংক্রমিত হলে মৃত্যু অবধারিত। তাই তাদের আতঙ্কের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। জিয়াংসুতে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ক্লাস পেছানো হয়। শিক্ষার্থীদের বলা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনলাইন ক্লাস হবে আর মূল ক্লাস কবে থেকে শুরু হবে তা পরবর্তীতে জানানো হবে। ২২ জানুয়ারি থেকে তাদেরকে বলা হল তারা রুমের বাইরে যেতে পারবেন না। তাদের ডরমিটরির নিচের গেইট তালাবদ্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থী আরিফ তালুকদার বলেন, যখন আমাদের ডরমিটরির নিচের গেইট তালাবদ্ধ করা হল তখন আমাদের আতঙ্কের মাত্রা আরও যায়। এখান থেকে কিভাবে বের হওয়া যায় সে ব্যাপারে আমরা ৫৬জন বাংলাদেশী মিলে মিটিং করলাম। একবার নয়, অনেকবার মিটিং করলাম আমরা। এরমধ্যে খবর আসে চীনে একের পর এক প্রদেশ লক ডাউন করে দেয়া হচ্ছে। যে প্রদেশ লক ডাউন করা হচ্ছে এই শহরগুলাতে কাউকে বের হতে দিচ্ছে না, ঢুকতেও দিচ্ছে না। প্রতিটি আপডেট নিউজে শুধু হতাশা ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি আমরা। আক্রান্তের সাথে সাথে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছিল। শিক্ষার্থী রিফাত বলেন, এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কি করবো কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ২৭ জানুয়ারি আমরা বাংলাদেশি দূতাবাসের শরণাপন্ন হই। তাদের কল দিলে তারা বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। আপনাদের রাতে জানাচ্ছি আমাদের সিদ্ধান্ত। আমরা তাদের কলের অপেক্ষায় থাকি। এর মধ্যেই অনেকেই বলতে থাকে, বাংলাদেশি দূতাবাসের কেউ কল রিসিভ করছে না। এরপর যখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাইকে ফিরিয়ে নিবেন তখন দূতাবাসের লোকদের পাওয়া যায়। রাতে আবার আমরা তাদের কল দেই। তখন দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলেন, আমরা আপাতত উহানে যারা আছে তাদের নিয়ে ভাবছি। তোমরা নিজেদের চিন্তা করো এবং পারলে দ্রুত দেশে চলে যাও। রিফাত বলেন, তাদের কথা শুনে আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের শহর লক ডাউন হওয়ার আগে বাংলাদেশে যেতে হবে। সরকারের আসা করলে আর যেতে পারবো না। তখন বাসায় কল দিয়ে সব বলার পর বাসা থেকে ফেরার ব্যবস্থা করতে বলে। আমরা যে টিকেটে আসা যাওয়া করি এই টিকেট আমরা ওয়ানওয়ে তে কিনেছি ৩৫ হাজার থেকে ৪১ হাজার টাকা দিয়ে। শিক্ষার্থী আরিফ তালুকদার বলেন, ২২ জানুয়ারি থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠানের স্যাররা আমাদের হাই সিকিউরিটিতে রুমের ভিতর আটকে রাখলেন। ৩০ জানুয়ারি থেকে স্যাররা বললেন, আমাদের যা প্রয়োজন তাদের বললে তারা ব্যবস্থা করে দিবেন। এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের পরিবারের সদস্যরা চিন্তায় পড়ে যান, সাথে আমরাও। আমরা খাবার যে রান্না করে খাব তাও পারছিলাম না। আরিফ আরও বলেন, আমরা যারা চীনে আছি তাদের নিয়ে যখন টিভিতে নিউজ হচ্ছিলো, তখন নিউজের নিছে এত এত বাজে কমেন্ট দেওয়া হয়েছে। যা দেখে মনে হয়েছিল, আসলে আমি কি বাংলাদেশের নাগরিক। কেউ এটা বুঝতে পারছে না, দেশে থেকে সবাই এত ভয় পাচ্ছেন। আর আমরা ভাইরাসের খুব কাছে থেকে সংক্রমিত না হয়েও রুমের ভিতরে প্রতিটি দিন আতঙ্কে মরেছি। শিক্ষার্থী রিফাত বলেন, আমরা যখন আমাদের ক্যাম্পাস থেকে বের হবো তার আগে আমাদের যে ডরমিটরির দায়িত্বে ছিলেন তিনি আমাদের প্রত্যেককে মেডিকেল চেক করেন। তারপর যখন গাড়ি দিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঢুকি তখনও আমাদের চেক করা হয় মেডিকেল টিম দিয়ে। চীন এয়ারপোর্টের ভিতরেও মেডিকেল চেকআপ করা হয়। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলেও সত্যি, আমাদের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাদের কোন প্রকার মেডিকেল চেকআপ করেনি। শুধু একটা ফরম পূরণ করিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।


     এই বিভাগের আরো খবর