,

ধরন বদলে বিপদ বাড়াচ্ছে করোনা

সময় ডেস্ক ॥ গত বছরের ডিসেম্বরে প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে দুটি প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে করোনাভাইরাস। প্রাণঘাতী এই ভাইরাস নিয়ে চীনের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের দীর্ঘ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। বেইজিংয়ের পেকিং বিশ্ববিদ্যালয়, সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর গবেষকরা গবেষণাটি পরিচালনা করেন। চীনা বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমানে একই করোনাভাইরাসের দুটি ধরন মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে এবং অধিকাংশ মানুষই সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ধরনটিতে সংক্রমিত হচ্ছেন। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৯৪ হাজার ৭৮ জন এবং
প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩ হাজার ২১৮ জন। আক্রান্ত ও নিহতদের অধিকাংশই চীনের। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। তখন থেকে সংক্রমিত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ৫০ হাজার ৬৯২ জন।
বেইজিং ও সাংহাইয়ের বিশেষজ্ঞ দল বলছেন, আক্রান্তদের প্রায় ৭০ শতাংশই সংক্রমিত হয়েছেন এই ভাইরাসের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ধরনটিতে। আক্রমণাত্মক প্রজাতিটি ছড়াতে শুরু করে জানুয়ারির শুরুর দিকে। যে কারণে সংক্রমিত হওয়ার পরপরই মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু বর্তমানে একটি পুরোনো ও শান্ত প্রজাতি বেশি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।
এভাবে ধরন বদলানোর কারণে ভাইরাসটির চিকিৎসা অথবা শনাক্তকরণ কঠিন হতে পারে। একই সঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার পর যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের পুনরায় এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকরা মাত্র ১০৩টি নমুনার ওপর গবেষণা চালিয়ে করোনাভাইরাসের রূপান্তরের ধরন নিশ্চিত হয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত গবেষণা দরকার বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তারা।
করোনাভাইরাসের ১০৩টি নমুনার জিন নিয়ে গবেষণা করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। তারা এই জিনের নাম দিয়েছেন সার্স-কোভ-২। এই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ এ তারা দুটি প্রজাতি পেয়েছেন; যার নাম দেয়া হয়েছে এল এবং এস।
বিজ্ঞানীদের দাবি, আক্রান্তদের প্রায় ৭০ শতাংশই এল প্রজাতিতে সংক্রমিত; যা এস-এর চেয়ে আক্রমণাত্মক এবং দ্রুতগতিতে বিস্তার ঘটায়। প্রাদুর্ভাব শুরুর পর করোনার এল প্রজাতিটি খুব বেশি দেখা যায়নি। এই সময় এস প্রজাতিটি মানুষের শরীরে বেশি সংক্রমণ ঘটায়। তবে জানুয়ারির শুরুর দিকে এল প্রজাতিটির দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকে।
এস প্রজাতিটি তুলনামূলক কম আক্রমণাত্মক হলেও এটিই প্রথমে মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। এখনও এস প্রজাতিটির সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। করোনাভাইরাসের এই প্রজাতিটি তুলনামূলক কম ক্ষতিকর। আর এর প্রভাব দীর্ঘদিন পরে পরিলক্ষিত হয়; যে কারণে আক্রান্তরা দীর্ঘ সময় ধরে এটি বয়ে বেড়াতে পারেন।
অধ্যাপক জিয়া লু এবং চিকিৎসক জি সুই করোনাভাইরাসের এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা বলছেন, জানুয়ারির শুরুর দিকে এল প্রজাতিটির প্রাদুর্ভাব প্রাথমিক পর্যায়ে বেশি ছিল। জানুয়ারির শেষে দিকে হুবেই প্রদেশের উহানে এই প্রজাতিতে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা কমে এসেছে। তবে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ বাড়ায় নতুন করোনাভাইরাসের এই প্রজাতিটি আরও দ্রুত গতিতে এবং আক্রমণাত্মকভাবে বিস্তার ঘটাতে পারে।
‘অন্যদিকে, এস প্রজাতিটি বিবর্তনগত দিক থেকেই পুরোনো এবং কম আক্রমণাত্মক। বৈশিষ্টগতভাবে দুর্বল হলেও এই প্রজাতিটি পুনরায় সংক্রমণ বৃদ্ধি করতে পারে।’
বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, করোনাভাইরাসের এল প্রজাতিটির সংক্রমণের মাত্রা শুরুর দিকে বেশি ছিল এবং মানুষ দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তারা তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা নেয়ার জন্য হাসপাতালে যান এবং তাদের আইসোলেশনে পাঠানো হয়। যে কারণে প্রজাতিটি ব্যাপকমাত্রায় বিস্তার ঘটানোর কম সুযোগ পেয়েছে।
‘মানবীয় হস্তক্ষেপ অর্থাৎ ভাইরাসে সংক্রমিতদের হাসপাতালে ভর্তি এবং সংক্রমিত এলাকা অবরুদ্ধ করায় এটি এসব নির্ধারিত এলাকায় দ্রুতগতিতে বিস্তার ঘটায়। যেকোনো এক প্রজাতিতে সংক্রমিত লোকজনকে যদি দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়, তাহলে অন্যান্য মানুষের মাঝে প্রজাতিটির বিস্তার ঘটানোর সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়বে।’
‘ভাইরাসটি মানুষকে গুরুতর অসুস্থ করে ফেললেও সংক্রমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একেবারে বিছানায় পড়ে যাওয়া কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কাশি ও হাঁচির মাধ্যমে বিস্তার ঘটায় সম্ভাব্য অন্যান্য রোগীদের কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।’
চীনা বিজ্ঞানীদের এই গবেষণায় বলা হয়েছে, বেশি সংখ্যক মানুষকে সংক্রমিত করতে না পারলে একটি নির্ধারিত সময়ের পর ভাইরাসটি মারা যায় অথবা বেঁচে থাকার জন্য ধরন পাল্টে ফেলে। আর এই ধরন পাল্টে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে এটি আরও শক্তিশালী হয়ে বিস্তার ঘটাতে থাকে।
কিন্তু এস প্রজাতিটি দুর্বল ধাঁচের হওয়ায় সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে লক্ষণ প্রকাশ পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এই সুযোগে প্রজাতিটি ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মাঝে বিস্তার ঘটানোর ঝুঁকি তৈরি করে।
অধ্যাপক জিয়া লু এবং চিকিৎসক জি সুই বলছেন, এসব অনুসন্ধান কোভিড-১৯ রোগীদের ক্লিনিক্যাল লক্ষণের রেকর্ড চার্ট, মহামারিবিষয়ক তথ্য, জিনোম সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ব্যাপক পরিসরে অতি-শিগগিরই গবেষণা পরিচালনার তাগিদ দিচ্ছে।
চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সের বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ন্যাশনাল সায়েন্স রিভিউয়ে চীনা গবেষকদের এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।


     এই বিভাগের আরো খবর