,

প্রতিকী ছবি করোনাভাইরাস (কোভিড-19)

বৈশ্বিক মহামারীতে আমাদের হবিগঞ্জ সচেতন হব কবে?

এড. মইনুল হাসান দুলাল :  মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে গজব? না-কি পৃথিবী নিয়ন্ত্রনে মানবসৃষ্ট কোন অপকৌশল? টক অব দ্যা ওয়াল্ড ঈঙঠওউ ১৯ . সৃষ্টির শুরু থেকেই মানব জাতীর চারিত্রিক অধঃপতনের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে যোগে যোগে এরূপ মহামারী আবির্ভাব ঘটেছে, তেমনিভাবে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ বা ক্ষমতার মোহে পড়ে মানব সৃষ্ট অনেক জীবানু অস্ত্র অবিস্কারের কারণে লক্ষ কোটি মানুষ এর করাল থাবায় প্রাণ হারিয়েছেন। মানব সৃষ্ট বা খোদায়ী গজব যাই হোক না কেন, এর উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতেই পারে। কিন্তু এই বৈশি^ক মহামারী করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় পৃথিবীর শ্রেষ্ট বিজ্ঞানীরা একের পর এক সব চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ঈঙঠওউ ১৯ থেকে বাঁচতে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের উপরেই জোর দিচ্ছেন। নোভেল করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল পৃথিবীর তৃতীয়
বৃহত্তম দেশ গন চীন এখন সারা বিশে^ এক রহস্যের চাদরে আচ্ছাদিত। একদিকে করোনার প্রভাবে সারা পৃথিবী ব্যাপী প্রায় দুই লাখ আট হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে, অন্যদিকে মৃতের সংখ্যা মাত্র চার হাজার ছয়শ তে নিয়ন্ত্রন রেখে চীন সারা বিশ^কে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ঈঙঠওউ ১৯ এর জিরো থেকে খুজতে গেলে ২০১৯ সালের শেষের দিকে উহান নগরীর হুয়ানান সামুদ্রিক খাদ্যের পাইকারী বাজারে দোকানদারদের মধ্যে প্রথম ভাইরাসটি সংক্রমন ঘটে বলে ধারণা পাওয়া যায়। বাজারটিতে জীবন্ত বাদুর, সাপ ও অন্যান্য বন্য প্রানী ও তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিক্রি করা হতো। প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হয়, কোন প্রানীর দেহ থেকে বিবর্তিত হয়ে আরেকটি মধ্যবর্তী পোষক প্রানীর মাধ্যমে মানবদেহে ইহা সংক্রমিত হয়েছে। এর পাদূর্ভাব ক্রমেই বাড়তে থাকলে চীনের বিজ্ঞানীরা ৭ জানুয়ারী এটিকে করোনা ভাইরাস হিসাবে ঘোষনা দেন। ৩০ জানুয়ারী ডঐঙ এই পাদুর্ভাবকে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য উদ্বেগজনক জরুরী অবস্থা ঘোষনা করে। ১১ মার্চ এর পাদুর্ভাব বিশে^র বিভিন্ন দেশের সম্প্রদায়ে সঞ্চালন ঘটায় ডঐঙ একে বৈশি^ক মহামারী হিসাবে ঘোষনা করে। উন্নত বিশে^র দেশ বৃটেন, যুক্তরাষ্ট, ইতালি, স্পেনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো যেখানে মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন রেকর্ড অতিক্রম করছে সেখানে এর উৎপত্তি স্থল তথা চায়নিজরা সারা পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে তাদের লকডাউন শিথিল করে নিজেদের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে দেদারসে। আমাদের দেশে করোনা আগমন ও বিস্থার রোধে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভুমিকা একেবারেই নগন্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উন্নত বিশ^ এই পরিস্থিতিতে বেসামাল ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেও আমাদের দেশে এরূপ মহামারীতে দ্বায়িত্বরত কর্তাব্যক্তিদের লাগামহীন আচরণ ও বক্তব্য দেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে বারবার ব্যথিত করেছে। শুরুতে করোনা মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি রয়েছে বললেও পরিস্থিতি যখন খারাপের দিকে যাচ্ছে তখন করোনার ফ্রন্ট যোদ্ধা ডাক্তার নার্সদের চচঊ সময়মতো সরবরাহ করতে ব্যর্থ এমনকি সরববাহকৃত ঘ৯৫ মাস্ক গুলো নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। আগেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি রয়েছে বললেও সিলেটের ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়ে সময়ের প্রয়োজনে এয়ার এম্বুলেন্স,আইসোলেশন খুজেও পাননি। দেশে করোনা যখন ধীরে ধীরে করাল থাবা বসাতে শুরু করেছে ঠিক তখনই ইতালি ফেরত বিশাল বহরের বিমান যাত্রীদের শুধুমাত্র শিলমোহর দিয়ে তাদের ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইন এর প্রেসকিপশন হাতে ধরিয়ে দিয়ে সরকার তাদের দ্বায়িত্ব পালন করেছেন, সর্বনাশের শুরুটা কিন্ত এখান থেকেই। সরকারী হিসেব মতে, ২৭শে এপ্রিল পর্যন্ত ৫৯১৩ জন করোনায় আক্রান্ত যার মধ্যে ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী প্রায় ১ হাজারেরও বেশি। দেশে প্রতিদিন গড়ে মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, যার ফলে প্রকৃত করোনা পজিটিভের সংখ্যা নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরাও সন্ধিহান রয়েছেন। এদিকে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য গনস্বান্থ্য কর্তৃক প্রস্ততকৃত কীট সরকার সরবরাহ না করায় জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সিলেট বিভাগের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ প্রবাসী অধ্যুষিত ও শিল্পাঞ্চল হওয়ায় সারাদেশের ন্যায় চরম ঝুকিতে সৌন্দর্য্যরে লীলাভুমি খ্যাত এ জেলাটি। সময়োপয়োগী সিদ্ধানহীনতার কারণে এবং এর বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে না পারা এবং জনগনের সচেতনতার অভাবে হবিগঞ্জ আজ করোনার ডেঞ্জার জোনে পরিণত হয়েছে। হবিগঞ্জের শ্রমিকরা কাজের সুবাদে বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে ঢাকা নারায়নগঞ্জ গাজীপুর চট্টগ্রামে অবস্থান করে থাকেন। সরকার মহামারী মোকাবেলায় ২৬মে মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষনা, গনপরিবহন চলাচল সীমাবদ্ধতা, হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দিলেও হবিগঞ্জ বাসী সচেতন না হয়ে করোনা নিয়ে নানা রূপ ঠাট্টা বিদ্রোপ করে একে উড়িয়ে দিয়ে পাড়ায় মহল্লায় আড্ডা, গল্প গোজবে লিপ্ত হতে থাকেন। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে প্রশাসন থেকে বারবার মাইকিং করেও এর কোন প্রতিকার করা সম্ভব হচ্ছেনা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চুপিসারে ও প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষ হবিগঞ্জে আসায় দিন দিন বেড়েই চলছে আক্রান্তদের তালিকা। শুধু তাই নয়, কখনো কখনো প্রশাসনের চোখে ফাঁকি দিয়ে রাতের আধারে পন্য বাহী পরিবহন নিয়ে আক্তান্ত এলাকা থেকে লোকজন আসতে থাকায় পরিস্থিতি সর্বনাশ আকার ধারন করে। তাছাড়া অফিস আদালত বন্ধ হলেও বন্ধ হয়নি হবিগঞ্জের শিল্প কারখানা। এমতাবস্থায় গত ১১ এপ্রিল নারায়নগঞ্জ থেকে হবিগঞ্জে আসা মাইক্রোবাস চালক মোফাজ্জল হোসেনের নমুনায় প্রথম করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। এদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং গনদাবীর মুখে হবিগঞ্জের মাননীয় সাংসদ জনাব এড. আবু জাহির জেলা লকডাউন ঘোষনা করলেও জেলা প্রশাসন থেকে কয়েক ঘন্টা পরই তা অস্বীকার করা হলে হবিগঞ্জবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ২০
এপ্রিল লাখাই হেলথ কমপ্লেক্স এর একজন ডাক্তার ও একজন নার্সসহ মোট ১০ জন করোনায় পজিটিভ শনাক্ত হন। ২১ এপ্রিল ১ জন নার্স ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আজমিরিগঞ্জে বাড়িতে আসা একজন নারী গার্মেন্টস শ্রমিক করোনা আক্রান্ত হন । ২২ এপ্রিল ৫ জন, ২৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যকর্মীসহ ৩ জন, ২৪ এপ্রিল চিকিৎসকসহ ৫ জন, ২৫ এপ্রিল জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসক নার্স স্বাস্থ্যকর্মী ও ৩ ম্যাজিষ্ট্রেটসহ ২১ জন করোনায় শনাক্ত হন। ২৬ এপ্রিল
বানিয়াচংয়ের একজন এসিল্যান্ড করোনায় আক্রান্ত হন। হবিগঞ্জে করোনায় আক্রান্ত ৪৮ জনের মধ্যে ২২ জনই সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য কর্মী। দীর্ঘদিন হবিগঞ্জে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা একজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও গত এক সপ্তাহে জ্যামিতিক হারে বেড়ে সেই সংখ্যাটি ৪৮ জনে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও ২৫ এপ্রিল একদিনেই চুনারুঘাটের ৫ বছরের এক শিশু ও নিজামপুরের এক সিএনজি ড্রাইভার মৃত্য বরণ করেন। এসব আক্রান্ত রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও চিকিৎসা করতে গিয়েই আক্রান্ত হয়েছেন বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত স্বাস্থ্য কর্মীরা। এদিকে হবিগঞ্জের বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্রেক্স একে একে বন্ধ হতে থাকলেও শেষ আশার আলো ছিল আধুনিক জেলা সদর হাসপাতাল। কিন্তু বিধিবাম গত ২৫ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের অনেকেই আক্রান্ত হলে হবিগঞ্জের আকাশে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২৬শে এপ্রিল সিভিল সার্জনের অনুরোধে জেলা প্রশাসন আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের জরুরী সেবা বিকল্প রেখে ৩ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষনা করেন। আক্রান্তদের অধিকাংশই হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন এবং অন্যান্যদের হবিগঞ্জ হাসপাতালের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ গাজীপুর কিশোরগঞ্জ এর পরই আক্রান্তের দিক দিয়ে হবিগঞ্জের অবস্থান। সিলেট বিভাগের ৪টি জেলায় করোনা রোগীদের মধ্যে হবিগঞ্জ শীর্ষে রয়েছে। জেলার আরো পাঁচ শতাধিক সংগৃহিত নমুনার রিপোর্ট এখনো না আসায় হবিগঞ্জবাসীর মধ্যে উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক সামাজিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি হবিগঞ্জ জেলা সবসময়ই শান্তিপ্রিয় এলাকা হিসাবে পরিচিত। করোনা সংক্রামনের দিক থেকে সারা দেশে আমাদের অবস্থান ধীরে ধীরে ক্রমশ খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিগত দিনে সত্যিকার অর্থে লকডাউন ঘোষনা করা হলে হয়তো আজ এমন পরিস্থিতিতে পরতে হতো না হবিগঞ্জবাসীকে। চীন ও দক্ষিন কোরিয়া করোনা প্রতিকার করেনি তারা প্রতিরোধ করেছে সঙ্গনিরোধের মাধ্যমে। হবিগঞ্জ জেলায় করোনা মহামারী আকার ধারণ করার পূর্বেই চীন ও দক্ষিন কোরিয়ার ন্যায় গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ জনগনকে হোম কোয়ারেন্টাইন কঠোর ভাবে মেনে চলার অভ্যাস করতে পারলেই এর প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন স¦াস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এখনো সময় আছে আমাদের সচেতন হতে হবে। আসুন সচেতন হয়ে নিজে সুস্থ থাকি অন্যকে সুস্থ রাখি।


     এই বিভাগের আরো খবর