,

টিভি মহামারী

সম্প্রতি টিভি চ্যানেলের বিস্তৃতি ও ছড়াছড়ি মহামারী আকার ধারণ করেছে। অনেক সিয়াম পালনকারী (রোজাদার) ভাই-বোনদেরকেও টিভির সামনে জেঁকে বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের দিন-রাত অতিবাহিত হয় টিভি-পর্দার সামনে। তাদের সিয়াম পালনে কী ফায়দা! কী স্বার্থকতা! খাদ্য-পানীয় থেকে বিরত থেকে তারা শুধু শুধুই নিজেদেরকে কষ্ট দিচ্ছেন। ইবাদতের এই স্বর্ণসময়গুলো অযথাই নষ্ট করছেন। ভেবে দেখা উচিত, টিভি পর্দার সামনে কী ধরণের প্রোগ্রাম দেখানো হচ্ছে। যারা এসব প্রোগ্রামের নির্মাতা, উপস্থাপক ও অভিনেতা-অভিনেত্রী তারা কি সুশিক্ষিত ধার্মিক শ্রেণীর কোন লোক? সিয়াম পালনকারী ভাই-বোনেরা প্রায়ই নিজেদেরকে নিষিদ্ধ পথে, নিষিদ্ধ মতে পরিচালিত করছে; সিয়াম পালনকারীদের জন্য যা খুবই দুঃখজনক। বেগানা নারীর প্রতি কামুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করা, গান-বাদ্য শুনা কি শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধের অন্তর্ভুক্ত নয়? অবৈধ টুর্নামেন্ট নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? একজন যুবতীর সাথে একজন পুরুষকে আলিঙ্গন করতে দেখাটাও তাদের রুচিতে বাঁধে না? তাদের নূন্যতম ইতস্তত বোধ হচ্ছে না যে, তারা শরীয়ত কর্তৃক অ-সমর্থিত বিষয়গুলি সাদরে গ্রহণ করে নিচ্ছে! নিজেদের অজান্তেই তাদের ঈমান-আকীদার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে! প্রিয় পাঠক! আমাদের ঈমানের যে ক্ষুদ্র অংশটি অন্তরের এক কোণে অবশিষ্ট ছিল, সেটুকুও তারা ধ্বংস করে দিচ্ছে! খোদাভীতির যে লেশটুকু ছিল, তাও নিঃশেষ করে দিচ্ছে! বরকতময় ও কল্যাণময় এই রামাদান মাসের তারা কি যথাযথ মূল্যায়ন করতে পেরেছে? পারছে? অথচ দেখুন! আমাদের পূর্বসূরী মনীষীদের রামাদান মাস। মহান আল্লাহর মাগফিরাত কামনায়, তাঁর ইবাদত-বন্দেগীতে দাঁড়িয়ে, বসে, সেজদায় লুটিয়ে বিনয়াবনত হয়ে আবেগাপ্লুত কন্ঠে স্রষ্টার নিকট অনবরত নিবেদন করে দিন-রাত অতিবাহিত করতেন! দোয়া কবুল হওয়ার বিষেশ মুহুর্তগুলোতে তারা এত বেশি আকুতি-মিনতি ও কান্নাকাটি করতেন, যার ফলে ফুটন্ত পানির টগবগ আওয়াজের মতো শব্দ তাদের বুক থেকে বের হত। প্রত্যেকেই এ মহৎ মাসে এক অনাবিল শান্তির পরশ অনুভব করতেন। কিন্তু বর্তমানে এসকল পুণ্যময় কাজ ও আল্লাহমূখী অবস্থার স্থান দখল করে নিয়েছে টেলিভিশনের বিভিন্ন প্রোগ্রাম; নাটক; সিনেমা; ক্রিকেট, ফুটবল সহ অন্যান্য খেলাধুলা ও টুর্নামেন্ট। টিভি পর্দার নির্মাতা, উপস্থাপক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, টিভির সামনে জেঁকে বসে থাকা ভাই-বোনেরা সহ যারা এই মহৎ মাসে শরীয়ত অ-সমর্থিত কাজে লিপ্ত, তারা কি অনুধাবন করতে পারে যে, তারা আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা জীব)? তাদের কীই বা করার ছিল, যদি মহান আল্লাহ তাদেরকে মুসলমান না বানিয়ে হিন্দু বৌদ্ধ বা অন্য কোনো অমুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করে দিতেন; যাদের কেউ গরুর অর্চনা-আরাধনা করে, কেউ প্রাণহীন পাথরের মূর্তির পূজা করে, কেউ বা আবার বলে আল্লাহ তিন জনের একজন কিংবা বলে- উযাইর (আঃ) আল্লাহর পুত্র। যদি কোনো বান্দা মহান আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে নিজেকে প্রস্তুত করে এবং নিজের কৃত অপরাধের জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে গোটা পৃথিবীর সব কিছুই তার মোকাবিলায় অতি তুচ্ছ, অতি নগণ্য। সুসংবাদ ওই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহর অনুগ্রহ সাদরে গ্রহণ করে, প্রকৃত খোদাভীতি অর্জন করে, রামাদানের রোজা রাখে; বিপুল পুণ্যার্জনে নিজেকে সর্বদা ব্যস্ত রাখে; সালাতে পিছিয়ে থাকে না; কারো গীবত পরনিন্দা করে না; কোনো মুসলমানের ক্ষতিসাধন করে না। সে যখন সওম পালন করে, সাথে সাথে তাঁর সর্বাঙ্গও সওম পালন করে। রামাদানের পুরস্কার সম্পর্কে এক হাদীসে বর্ণিত আছে- “আদম সন্তানের প্রতিটি কাজের বিনিময়কে দশ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, তবে সওমের প্রতিদান ব্যতিত। কেননা, সওম একমাত্র আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। বান্দা আমারই জন্য খাদ্য-পানীয় ও কামপ্রবৃত্তি পরিত্যাগ করে। সিয়াম (রোজা) পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দঘন মুহুর্ত রয়েছে। একটি ইফতারের মুহুর্ত। আরেকটি রব্বে কারীমের সাথে সাক্ষাতের মুহুর্ত। সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট কস্তুরির সুঘ্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়। [সহীহ মুসলিম: হাদীস নং-২৭৬৩] অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও পুণ্যের আশায় রামাদানের সওম রাখবে, মহান আল্লাহ তার পিছনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। [সহীহ বুখারী] আরও একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন সওম রাখবে, আল্লাহ তার চেহারাকে (তাকে) জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর বছর দীর্ঘ পথের দূরত্বে সরিয়ে দিবেন। [সহীহ মুসলিম: হাদীস নং-১১৫৩] অন্য এক হাদীসে রয়েছে- নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, জান্নাতের মধ্যে রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল মাত্র সিয়াম পালনকারী লোকেরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতিত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে- সিয়াম পালনকারী লোকেরা কোথায়? তখনই তারা উঠে দাঁড়াবে। তাদের ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। তাদের প্রবেশের পরপরই এ দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে, যাতে আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। নিঃসন্দেহে এ মহান পুরস্কার সেসব লোকদের জন্য নয়, যারা শুধু শুধুই নিজেদেরকে খাদ্য-পানীয় থেকে বিরত রাখে; সওমের কোনো হক ও আবেদন রক্ষা করে না। যারা যথাযথভাবে সওম পালন করবে, এ পুরস্কার কেবল তাদেরই জন্য বরাদ্দ থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আমাদেরকে টিভির মহামারী থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন! আমীন।

লেখক:

মাওলানা নাঈম আহমদ। (৮ নং ওয়ার্ড), ১০ নং দেবপাড়া ইউনিয়ন, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।


     এই বিভাগের আরো খবর