,

শবে ক্বদর কবে; শবে কদরের গুরুত্ব ও ফযীলত

আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক আজকে আমরা আলোচনা করব শবে’কদর নিয়ে ৷ আমাদেরকে প্রথমে বুঝতে হবে শবে’ক্বদর কি:- শবে’কদর হল ফার্সীতে যৌগিক একটা শব্দ ৷ যার আরবী হল লাইলাতুল কদর ৷ আরবীতে লাইলাতুন অর্থ যেমন রাত ঠিক তেমনি ভাবে ফার্সীতে ও শবে অর্থ রাত ৷ আর ,কদর অর্থ হল , ভাগ্য নির্ধারন , ভাগ্য বন্টন , আবার কেউ কেউ বলেছেন, সম্মানিত ৷ সুতারাং উভয় টার যৌগিক অর্থ হল, ভাগ্য নির্ধারনের রাত, ভাগ্য বন্টনের রাত, সম্মানিত রাত ৷ শবে’কদরের গুরুত্ব :- কদরের ফজিলত বোঝানোর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ‘কদর’ নামে আলাদা একটি সূরা অবতীর্ণ করেন। কদরের ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরায়ে কদরে এরশাদ করেন-নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কোরআনুল কারীমকে লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। উক্ত রজনীতে ফেরেশতাগণ ও জিবরাঈল (আ.) তাদের প্রতিপালকের নির্দেশে প্রত্যেক বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হন এটা শান্তিময় রজনী যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা আল কদর : ১-৫)। আরেক আয়াতে মহান আল্লাহ পাক বলেন, নিশ্চয় আমি তা (কোরআন) এক মোবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা আদ দুখান : ১-৪)। শুধুমাত্র কোরআন নয় বরং হাদিসেও কদরের ফজিলত সম্পর্কে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ৷ ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত রাসূল (সা.) বলেন, যে লোক শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয় সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিত হল। আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেলো কিন্তু ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই। কদরের রাতের ইবাদতের সুযোগ যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায় সেজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশদিনের পুরো সময়টাতে ইতেকাফরত থাকতেন। (মুসলিম, হাদিস নং : ১১৬৭)। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, শবে কদরে হজরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট এক দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (তাফসিরে মাজহারি)। এখন জানতে হবে শবে’কদর কবে :- পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাতের মধ্যে কোনো একদিন লাইলাতুল কদর। কিন্তু বর্তমান যুগে ২৭শে রমজান কে নির্দিষ্ট করে শবে’কদর পালন করা হয়, যা আদৌ নির্দিষ্ট নয় ৷ সুতারাং আমাদের জন্য উচিৎ হল শেষ দশদিনের বিজোড় দিন গুলোর প্রতি লক্ষ রাখা ৷ মূলত লাইলাতুল কদরের রাতকে নির্দিষ্ট করে দেখানো হয়নি। এ ব্যাপারে চল্লিশটিরও অধিক মতভেদ পাওয়া যায় ৷ আর হাদিসে ও রয়েছে আবহাওয়া বা ঝলমলে একটি প্রাশান্তির রাত হবে সেদিন। এই রাতটি হবে খুবই শান্ত ও শান্তিময়। এই রাত শেষে সকালটি হবে প্রশান্তির। এ রাতে প্রত্যেক বস্তুকে সেজদারত অবস্থায় দেখা যাবে। প্রতিটি স্থান হবে স্বর্গীয় আলোয় আলোকিত। সবচেয়ে সুস্পষ্ট নিদর্শন হচ্ছে, এই রাতের এবাদত অন্তরে তৃপ্তি জোগাবে। এটি দোয়া কবুলের রাত। আমাদের ভাগ্য রজনী বা মহিমান্বিত রজনী। এই রাতেই আল্লাহ তায়ালা আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন। রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার উদ্দেশ্য হলো শবে কদর প্রাপ্তিতে দৃঢ়তা আনয়ন। ইতিকাফের মূল কথা হলো সবকিছু ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়া। সুতারাং পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশ দিনের বিডোড় দিন গুলোর মধ্যেই রয়েছে শবে’কদর ৷ এব্যাপারে হাদিসে ও তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেছেন, কদরের রাত রমজান মাসের সাথে সম্পৃক্ত। তবে রমজানের সারা মাসেই তা পাওয়া সম্ভব রয়েছে। রাসুল (স.) বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকে ৯, ৭ ও ৫দিন অবশিষ্ট থাকতে তালাশ করো। (বুখারী: ১৯৮৫) রাসূল (সা.) আরও বলেন, ‘রমজানের শেষ দশদিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর। (মুসলিম, হাদিস নং: ১১৬৯)। * একদা হযরত উবায়দা (রা.) নবী করীম (সা.) কে লাইলাতুল কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তখন নবীজী সেই সাহাবিকে বললেন রমজানের বেজোড় শেষের দশ দিনের রাতগুলোকে তালাশ করো। (বুখারি, হাদিস নং: ২০১৭)। * হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি কেউ লাইলাতুল কদর খুঁজতে চায় তবে সে যেন তা রমজনের শেষ দশ রাত্রিতে খোঁজ করে। (মুসলিম, হাদিস নং : ৮২৩)। তাই ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ রমজানের রাতগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে ‘লাইলাতুল কদর’ লাভ করার জন্য রমজানের শেষ দশরাত জাগ্রত থেকে ইবাদতে কাটিয়েছেন এবং উম্মতে মুহাম্মাদীকেও সারা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল (সা.) বলেন, শবে কদরকে নির্দিষ্ট না করার কারণ হচ্ছে যাতে বান্দা কেবল একটি রাত জাগরণ ও কিয়াম করেই যেন ক্ষান্ত না হয়ে যায় এবং সেই রাতের ফজিলতের উপর নির্ভর করে অন্য রাতের ইবাদত ত্যাগ করে না বসে। তাই বান্দার উচিত শেষ দশকের কোন রাতকেই কম গুরুত্ব না দেয়া এবং পুরোটাই ইবাদাতের মাধ্যমে শবে কদর অন্বেষণ করা। এবার আমরা জানব শবে’কদরের আমল সম্পর্কে :- হজরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলে দিন, আমি যদি লাইলাতুল কদর কোন রাতে হবে তা জানতে পারি, তাতে আমি কী (দোয়া) পড়বো?রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বলবে- اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওয়ুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি। অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালো বাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত) প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের উচিত, রমজানের শেষ দশকে এ দোয়া বেশি বেশি পড়া। তার সাথে সাথে বেশি বেশি নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, সালাতুস তাসবিহ, উমরী কাজা নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সাদকা, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, তাওবা-ইসতেগফার, দুয়া-দুরূদসহ ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনযোগী হওয়া একান্ত জরুরি। সর্বপরি সকল মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা। পরিশেষে সকল পাপ পঙ্কিলতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা বিসর্জন দিয়ে মানসিক উৎকর্ষ ও প্রশান্তি লাভের জন্য শবে কদরের রজনীর সদ্ব্যবহার করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব এবং ইহাতে বিশ্ব শান্তি ও মানব কল্যাণ নিহিত। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে লাইলাতুল কদর দান করুন। লাইলাতুল কদরে যথাযথ ইবাদত বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন৷ এবং মুসলিম উম্মাহকে শবে’কদরের উচিলায় করোনা ভাইরাস নামক মহামারী থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

লেখক: আলী আহমাদ অধ্যয়নরত: ফযিলত ২য় বর্ষ (মিশকাত) জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া দিনারপুর বালিদ্বারা মাদ্রাসা।


     এই বিভাগের আরো খবর