,

বিমানের টিকিটের জন্য প্রবাসীদের হাহাকার

সময় ডেস্ক ॥ করোনা মহামারির আগে ছুটিতে দেশে ফেরা প্রবাসী কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছেন। অনেকের ছুটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। আবার অনেকে শিগগিরই কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে না পারলে কাজ হারাবেন। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক এই মহামারির কারণে গন্তব্যে যাওয়ার উপায় ছিল না তাদের। গন্তব্য দেশগুলোও বিদেশি শ্রমিক প্রবেশে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে। বন্ধ করে দেয় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল । এই অবস্থায় বেশির ভাগ প্রবাসী বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে ছুটিতে আসা প্রবাসীরা অর্থ সংকটে অসহায় দিন কাটাচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি বা তারপরে ছুটি নিয়ে দেশে ফেরা কর্মীরা তাই দমবন্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন। সমপ্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে। সে দেশে শ্রমিকদের প্রবেশের নিয়ম শিথিল করেছে। এরই প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট কয়েকটি এয়ারলাইন্স স্বল্প সংখ্যক ফ্লাইট চালু করেছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় চালু হচ্ছে বিমানের নিয়মিত ফ্লাইট। আর এতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন প্রবাসীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও টিকিট মিলছে না তাদের। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছেন তারা। টিকিটের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। জানা যায়, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হওয়ার আগে ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে সাড়ে চার লাখের মতো প্রবাসী কর্মী দেশে ফেরেন। এরপর বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ছিল জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। বাংলাদেশ থেকে সীমিত সংখ্যক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হলেও শ্রমিকদের মূল গন্তব্য দেশগুলোতে প্রবেশ বন্ধ ছিল। একদিকে সীমিত ফ্লাইট, অন্যদিকে অভিবাসী কর্মীদের মতো হঠাৎ যাত্রীদের চাপ বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে বিমান কোম্পানিগুলোও। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে শুধুমাত্র বিমান বাংলাদেশ, এমিরেটস, কাতার ও টার্কিশ এয়ারলাইন্স সীমিত সংখ্যায় মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইট পরিচালনা করছে। তাও শুধু কয়েকটি গন্তব্যে। আগে যেখানে শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-ই ১৭টি দেশে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করতো, সেখানে এখন মধ্যপ্রাচ্যের মাত্র দুটি দেশে- আবুধাবি ও দুবাই রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আগে সপ্তাহে ২১টি ফ্লাইট ছিল এমিরেটস এয়ারলাইন্সের। এখন তারা মাত্র চারটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত বিমান টিকিট না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষজন।
সরজমিন দেখা যায়, গুলশানে এমিরেটস-এর কার্যালয়ের ভেতরে, ভবনের লবি এবং রাস্তায় শত শত মানুষ। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তারা টিকিটের জন্য অপেক্ষায়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে সীমিত ফ্লাইট পরিচালনা করা সবগুলো এয়ারলাইন্সের কার্যালয়ে একই অবস্থা। রিটার্ন টিকিট কেটে যারা এসেছেন, তারা অনেকেই সেপ্টেম্বরের আগে ফিরতি ফ্লাইট পাচ্ছেন না। অনেকে জানান, তারা সেপ্টেম্বরের টিকিটও পাচ্ছেন না। গত কয়েকদিন ধরেই এ পরিস্থিতি চলছে। বিমান কর্তৃপক্ষ বলছেন, সবচেয়ে বেশি চাপ দুবাইগামী যাত্রীদের। এই গন্তব্যে সপ্তাহে ৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান। ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত বিমানের আবুধাবি ফ্লাইটের টিকিট শেষ। ফিরতি টিকিট যাদের আছে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেপ্টেম্বরের টিকিট দেয়া হবে।
মতিঝিল বলাকা ভবনে বিমান অফিসের টিকিট বিক্রয়কেন্দ্রের সামনে লোকজনের জমজমাট ভিড় দেখা গেছে। টিকিট কিনতে আসা আবুধাবি ফেরত কয়েকজন প্রবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাইরের লোকাল এজেন্সিগুলোতে টিকিট পাওয়া গেলেও বিমানের টিকিট বিক্রয় কেন্দ্র থেকে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। একের পর এক তারিখ পরিবর্তনের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। এদের বেশির ভাগের ভিসার মেয়াদ শেষের দিকে, কারো আবার মেয়াদ নেই। আরেক প্রবাসী জানান, ছয় থেকে সাত মাস আগে দেশে এসেছেন তিনি। তার ভিসার মেয়াদও শেষের দিকে। আরেক প্রবাসীর অভিযোগ টিকিট নেই কেন জানতে চাইলে বাইরে যোগাযোগ করতে বলা হয় তাকে। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া আর সময়মতো টিকিট না পাওয়ায় ফেরা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন এসব প্রবাসী কর্মীরা।
বিমানের এমডি এম মোকাব্বির হোসেন জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে কিছু ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। ফ্লাইট ওপেন করা হলে যাদের কাছে আগের টিকিট আছে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফ্লাইট চালানোয় আসন সংখ্যার চেয়ে কম যাত্রী পরিবহন করতে হচ্ছে। আবার কর্মক্ষেত্রের কাগজপত্র ঠিক না থাকায় অনেককে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাচ্ছে আমিরাতের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, যাদেরকে আমিরাতের কর্তৃপক্ষ একসেপ্ট করছে না, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তাদের এমডিসির মাধ্যমে বা ভিসার মেয়াদ না বাড়ানো পর্যন্ত টিকিট দেয়া হবে না। বিমান এমডি বলেন, মার্চ মাসের শেষ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিমানবন্দরগুলো বন্ধ। সংযুক্ত আরব আমিরাত সমপ্রতি সীমিত আকারে ফ্লাইট চালুর অনুমতি দিয়েছে। আগে কয়েকটি শর্ত ছিল। তার মধ্যে একটি হলো শ্রমিকদের সেখানকার সরকারি একটি ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হবে। অনুমোদন পাওয়া গেলেই তারা যেতে পারবে। সেই নিয়মটি এই দশ তারিখে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মোকাব্বির হোসেন বলেন, এখন পাঁচ মাসে যারা যেতে পারেননি তারা সবাই পারলে আজকেই যেতে চান। ফলে এই মাসের দুই সপ্তাহের যে ফ্লাইটগুলো ছিল তার টিকিট নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে। তাছাড়া যারা ফিরতি টিকিট কেটে দেশে এসেছিলেন তাদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যে কারণে নতুন যারা টিকিট কাটতে চাইছেন তারা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন।

এদিকে আজ থেকে মালয়েশিয়াগামী বিমান চালু হওয়ায় এ রুটেও যাত্রীর চাপ বাড়বে বলে বিমান সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে বিমান টিকিটের বেশি হাহাকার সিলেট এবং চট্টগ্রামে। আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সিলেটে লন্ডনগামী কয়েক হাজার যাত্রী আটকা পড়ে আছেন। সপ্তাহে একটি ফ্লাইট বিমান পরিচালনা করায় তারা যেতে পারছেন না। একইভাবে দুবাইগামী কয়েক হাজার যাত্রী রয়েছেন সিলেটে। দুবাই থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করায় তারা এখন কাজে ফিরতে চান। কিন্তু তারা টিকিট পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় বিদেশগামী যাত্রীরা কর্মসূচিও পালন করেছেন। কিন্তু এখনো পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা না করলে এ জটিলতা কাটানো যাবে না।

এদিকে, মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের বিমান টিকিট প্রাপ্তিতে জটিলতা, হয়রানি ও অব্যবস্থাপনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রয়োজনে বিমানে বিশেষ ফ্লাইট চালুর দাবি জানিয়েছেন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, ক্যাব মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু, সাধারণ সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, যুগ্ম সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম, সংগঠনটির চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সভাপতি আলহাজ আবদুল মান্নান, ক্যাব যুব গ্রুপের সভাপতি চৌধুরী কে এন এম রিয়াদ ও সম্পাদক নিপা দাস এ দাবি জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, বিমান টিকিট নিয়ে বিমান বাংলাদেশ-এর লুকোচুরি, অব্যবস্থাপনা, ঈদ ও কোরবানির সময় গণপরিবহনের টিকিট সংকটকেও হার মানিয়েছে। দেশের রেমিট্যান্সযোদ্ধারা, দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে। তাদের প্রতি এ ধরনের অমানবিক ও বিমাতাসুলভ আচরণ খুবই দুঃখজনক ও অনাকাঙ্খিত।


     এই বিভাগের আরো খবর