,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব আয়োজিত ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও সংকট’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় ১৭ প্রস্তাবনা ও পরামর্শ

মতিয়ার চৌধুরী, লন্ডন : বিদেশে বসবাসরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যালামনাইদের মধ্য থেকে মেধাবী শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর আখতারুজ্জামান। গ্রেটব্রিটেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাইদের সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব আয়োজিত ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও সংকট’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় তিনি একথা বলেন। উপাচার্য আরো বলেন বিদেশে বসবাসরত এ্যালামনাইরা যাতে তাদের মেধা ও দক্ষতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজে লাগাতে পারেন সেজন্য প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ প্রফেসর পদ সৃষ্টি করে তাদেরকে স্বাগত জানানো হবে। গেল শনিবার ৫সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে সঞ্চালিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় তিনি আরো জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী বছরের ২১ জানুয়ারী ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনের জন্য সম্মতি দিয়েছেন । লন্ডন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের ফাউন্ডার সদস্য বিধান গোস্বামী ও সাংবাদিক তানভির আহমদের সঞ্চালনায় চার ঘন্টাব্যাপী ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তহন আলোচনবৃন্দ। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল । ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় আলোচকবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ১৭টি প্রস্তাবনা ও পরামর্শ তুলে ধরেন ।০১. বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের অহেতুক অর্থ ও সময় অপচয় রোধে ভর্তি পরীক্ষাটি কিভাবে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রহণ করা যায় তার পথ খুঁজতে হবে। ০২. বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি স্যাট, জিআরই, টোয়েফেল, আইএলটিএসের ভিত্তিতে ছাত্র ভর্তি করতে পারে তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন আলাদা করে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে হবে? ০৩. শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পাঠ দানের পর শিক্ষার্থীদের দ্বারা মূল্যায়নের সুযোগ থাকতে হবে। ০৪. শিক্ষার্থীদের জন্য কম মূল্যে পাঠ্যবই প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে , বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী ও সেমিনারে পর্যাপ্ত বই প্রাপ্তির জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ০৫. ওর্যাংকিং-এ মান বাড়াতে গবেষণা ও সাইটেশনে গুরুত্ব দিতে হবে, আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা
প্রকাশের উদ্যোগ নিতে হবে। ০৬. শিক্ষকদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করে সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। ০৭. লাইব্রেরী শুধুমাত্র বিসিএসর জন্য রিডিং রুম না বানিয়ে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। লাইব্রেরীতে শিক্ষার্থীদের বসার জন্য পর্যাপ্ত আসন নিশ্চিত করা। ০৮. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক হলে ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফ্রি ওয়াই-ফাই সুবিধা দেওয়া। ০৯. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাইক্রো লেভেলের রাজনীতি থেকে আলাদা করা। ১০. ফ্রি বেতন না রেখে যে সকল অভিভাবকদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের কাছ থেকে ফি নেওয়া। বিষয়টি কার্যকর করতে পাবলিক কনসালটেশনের আয়োজন করা। ১১. বিদেশের মতো বাংলাদেশের বিত্তশালীদের মধ্যে দানের সংস্কৃতি গড়ে তোলার অভ্যাস তৈরী করতে হবে যেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে অনুদান দেন। ১২. বিশ্ববিদ্যালয়কে শতভাগ টিচিং ইউনিভার্সিটি না রেখে রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মনোযোগী হতে হবে ১৩. ফ্যাকাল্টি জার্নালে ঢালাওভাবে ডিনদের সম্পাদক হিসেবে না রেখে বিদেশী বা বা বিদেশে অবস্থানরত দক্ষ এ্যালামনাইদের যুক্ত করা যেতে পারে। ১৪. এন্ডালমেন্ট ফান্ড তৈরীতে বিদেশী এ্যালামনাইদের যুক্ত করতে হবে।একটি প্রফেশনাল বডির মাধ্যমে ফান্ড রেইজিং প্রজেক্ট তৈরী করা। ১৫. আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইংল্যান্ডে এসে বার এ্যাট ‘ল’ পড়তে চাইলে তাদের পুনরায় ব্রিটেনের ডিগ্রী গ্রহন করতে হয়, এতে সময় ও অর্থ অপচয় বন্ধ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হবে। ১৬. বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবৈধদের দৌরাত্ম্য রোধে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের হলে আসন সংকটের সমাধান করতে হবে। ১৭. শিক্ষার্থীদের খুব সহজে নোট নির্ভর পরীক্ষা থেকে সরিয়ে চ্যালেঞ্জিং ও দায়িত্বশীল করা। আলোচনায় প্রধান অতিথি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল বলেন স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে সরকারকে সহযোগী মনে করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সরকার সকল প্রকার সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে। জ্ঞান অর্জন ও এগিয়ে যাওয়ার জন্য স্বায়ত্তশাসন থাকবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিউশন ফি কেন্দ্রিক নয়, সেখানে জনগণের অর্থে শিক্ষা দেওয়া হয়। তাই পাশ্চাত্যের উচ্চমানের টিউশন ফি নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা চলে না। উচ্চশিক্ষার বানিজ্যিকী করণের পেছনে না ছুটে শিক্ষার মান উন্নয়ন, একাডেমিক পরিবেশের উন্নয়ন, জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি কি করতে পারছে সেটির উপর গুরুত্ব দিতে হবে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ও এগিয়ে যাওয়ার জন্য স্বায়ত্তশাসন, তবে সরকারের সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপটা যেন অবৈধ ও অন্যায্য না হয়। এমআইটি, হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ যদি উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ও জিআরটি, স্যাট, আইইইএলটিস, টোফেল এসেসমেন্টের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারে, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন পারবে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের বাড়তি চাপ তৈরী করা হচ্ছে? কোভিডকালীন সময়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সময় ও অর্থ অপচয় করতে হয। শিক্ষা মন্ত্রী বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মের অভিযোগ আসলেও স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার কারণে সরকার কার্যকরি ব্যবস্থা নিতে পারে না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে গবেষণা সংকট রয়েছে সেই সংকট দূর করতে বিদেশে বসবাসরত এ্যালামনাইরা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।” ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় সম্মানিত অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য (শিক্ষা) প্রফেসর এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যালামনাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি এন্ডালমেন্ট ফান্ড তৈরীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করেন। সেই প্রক্রিয়াটি এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ্যালামনাইরা সহযোগিতা করলে সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব।’ ভার্চ্যুয়াল এই আলোচনায় আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর এ এস এম আমানউল্লাহ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বদেব চৌধুরী, অষ্ট্রেলিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত ইংরেজী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নীলিমা আক্তার, কমিউনিকেশন্ ও ডিসঅর্ডার বিভাগের চেয়ারপার্সন শান্তা তাওহিদা, এমআইটি সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয় লেকচারার ড. তুষার কান্তি দাশ, অষ্ট্রেলিয়াতে কনজ্যুমার কমিশনে কর্মরত আইটি কনসালটেন্ট তুষার রায়, কানাডার ডালহাউসি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার মোহাম্মদ এহসান, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামা এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটির এসোসিয়েট প্রফেসর এ কে এম ওয়ারেসুল করিম। ব্রিটেনে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে এ্যালামনাইদের পক্ষ থেকে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব লিংকনের সিনিয়র লেকচারার ড. মাহফুজ রহমান, ইষ্ট লন্ডন ইউনিভার্সিটির লেকচারার সোহাইল মোতাহির চৌধুরী। ব্রিটেনের বিশিষ্ট আইনজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ম্যানেজমেন্টের সদস্য ড. আশরাফ উদ্দীন, ব্রিটেনের থার্ড সেক্টর কনসালটেন্ট বিধান গোস্বামী ও ডাইরেক্ট পাবলিক একসেস ব্যারিস্টার চৌধুরী হাফিজুর রহমান। ভার্চ্যুয়াল এই আলোচনায় ছিল প্রশ্নোত্তর পর্বও। প্রশ্নোত্তর পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য ও মাননীয় উপমন্ত্রী প্যানেলিস্টদের প্রস্তাবনাগুলোকে গুরুত্ব দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। উপ উপাচার্য প্রফেসর মাকসুদ কামাল জানান পূর্বাচলে ৫২ একর জমির উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরীর প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে, সেখানে সিঙ্গাপুরের আদলে একটি মেডিক্যাল সেন্টার নির্মানের পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। প্রযুক্তি দূর্বলতার জন্য কোভিড নাইনটিনের সময় শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠ দান সম্ভব হয়ে উঠেনি বলে দু্ঃখ প্রকাশ করেন উপ-উপাচার্য। তবে খুব শিগগিরই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডোমেইন থেকে ইমেইল এ্যাড্রেস দেওয়ার কাজ চলছে বলে জানান তিনি। শিক্ষক নিয়োগ ও পাঠদান সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে একটি এথিকাল কমিটি গঠনের কথাও জানান প্রফেসর মাকসুদ কামাল। প্রশ্নোত্তর পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ইউকের ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে অংশ নেন ব্যারিস্টার অজয় রাজ রতন, আমীরুল ইসলাম চৌধুরী, এ্যাডভোকেট শাহ আলম সরকার, ব্যারিস্টার কাজী আশিকুর রহমান, এ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম, হিমিকা আযাদ, আবদুল মোতালেব সহ অন্যরা।


     এই বিভাগের আরো খবর