,

শহীদ উদ্দিন চৌধুরী: আলোকিত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব -রুহুল হাসান শরীফ

কোন বাহিনী নেই, গাড়ীর বহর নেই, গ্রুপ নেই, অর্থ বিত্তের ও তেমন উত্তাপ নেই। সাদা সিঁদে বিনয়ী জীবন যাপনে বিশ্বাসী, একটি জীপ গাড়ীই ছিল তার সকল আভিজাত্য। শিশু সংগঠন, পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, সামাজিক সাংস্কৃতিক সর্বোপরি হবিগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নিবেদিতচিত্ত ও আলোকিত ব্যক্তিত্ব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী। ছাত্র রাজনীতি দিয়ে শুরু। বিগত অর্ধ শতাব্দিকাল আর থেমে থাকেন নি। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ করেছেন। আজ হবিগঞ্জ জেলায় জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন তিনি। শহীদ চৌধুরী স্বাধীনতা পূর্বকালে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারী কলেজ (তৎকালে বেসরকারী) ছাত্রসংসদের সহ-সাধারণসম্পাদক, পরবর্তীতে ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ এ গণ অভ্যুত্থান ও তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মূলনেতা হিসেবে বলিষ্ট ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সংগঠক ও সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালনের গৌরব ও রয়েছে তার জীবন খাতায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.রব ও সেক্টর কমান্ডার মেজর সি আর দত্তের পরামর্শে হবিগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে ঘুরে তরুনদেরকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্ধুদ্ধ করে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রেরণ করেন। স্বাধীনতাত্তোরকালে ছাত্রত্ব শেষ হতে না হতেই তিনি হবিগঞ্জ পৌর সভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও ওই সময় মামলাজনিত কারণে তাঁকেই ‘চেয়ারম্যানের’ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সহজ সরল ও গনতন্ত্রমনা এই ব্যাক্তিকে হবিগঞ্জ পৌরসভার নাগরিকরা পর পর ৪ বার পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। জীবনের ২৫ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে তিনি হবিগঞ্জ পৌর সভাকে ৩য় শ্রেণী থেকে ১ম শ্রেনীতে উন্নীত করণ, নেদারল্যান্ড সরকারের সহযোগিতায় পানি শোধনাগার নির্মান করে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎতের কাঠের পুলের পরিবর্তে স্টিলের পুল স্থাপন ও তার রাবার কোড করা, কাঁচা লেট্রিনের স্থলে রিং লেট্ট্রিনের প্রচলন ও মাস্টার ড্রেন নির্মান করে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা সহ পৌরসভার ব্যাপক উন্নয়ন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পেয়ে হবিগঞ্জ-৩ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। বিএনপি ও চারদলীয় জোট বিরোধী আন্দোলনে সংক্রিয় ভূমিকা পালন করায় তাঁকে নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ওই সময় তার বাসভবনে হামলা, ভাংচুর ও বোমানিক্ষেপ করা হয়। রাজনৈতিক উত্তান, পতন, চড়াই উৎড়াই হুমকি ধামকি কোন প্রতিকুলতাই তাঁকে সমাজ উন্নয়ন থেকে দূরে রাখতে পারেনি। হবিগঞ্জের এমন কোন উন্নয়ন নেই যে, তার হাতের ছোঁয়া লাগেনি। শুধু রাজনীতিই নয়, জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও সংস্কৃতিক এবং শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মকান্ডে জড়িত রয়েছেন শহীদ চৌধুরী। তিনি প্রায় ৩৫ বছর যাবত হবিগঞ্জ পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে সম্মান করে ওই পদে এখনও কেউ নির্বাচনে অংশ নেন না। রাজনীতি, সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি একজন শিশু বান্ধব। ৯০ দশক থেকে শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘর আসরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া নাটাব, হবিগঞ্জ আহছানিয়া মিশন, কমিউনিটি পুলিশিং, গ্রেটার সিলেট ডেভেলপমেন্ট এন্ড ওয়েল ফেয়ার কাউন্সিল ইউকে এর সভাপতি। অপরদিকে নাটাব জাতীয় পরিষদ সদস্য, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সহসভাপতি, হবিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স, প্রেসক্লাব, রেড ক্রিসেন্ট, রাইফেল ক্লাবের সদস্য। হবিগঞ্জ জেলার প্রথম মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি সৌধের নির্মান কমিটি সদস্য। হবিগঞ্জের নন্দিত ব্যক্তিত্ব শহীদ চৌধুরী ১৯৯০ সালে হবিগঞ্জের রোটারী ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। জেলার শিক্ষার উন্নয়নে ও বলিষ্ট ভূমিকা পালন করছেন এ নিরঅহংকার মানুষটি। স্থানীয় নিরদাময়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, দি রোজেস কিন্ডার গার্টেন, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি স্থানীয় জে.কে এন্ড এইচ.কে হাই স্কুল এন্ড কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি। তিনি বিগত ২১ বছর ধরে হবিগঞ্জ ডায়বেটিক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রবাসীদের অর্থায়নে হবিগঞ্জে ডায়াবেটিক এন্ড জেনারেল হাসপাতাল গড়েছেন। হবিগঞ্জে সৃষ্টি করেছেন সেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হাসপাতালটির অর্থসংস্থান করতে দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করেন তিনি। এখনও প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা সময় ব্যয় করেন হাসপাতালের আঙ্গিনায়। এ হাসপাতালে তালিকাভুক্ত ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ১৫ হাজার। এ হাসপাতালে ডায়াবেটিসসহ কিডনি ডায়ালাসিস করা হয়ে থাকে। ১৫০ শয্যার এ হাসপাতালে ডায়াবেটিস চিকিৎসার পাশাপাশি চালু করা হয়েছে গাইনী, দন্ত বিভাগও। অপরদিকে শহীদ চৌধুরী ঐ হাসপাতালের তৃতীয় তলায় অটিস্টিক শিশুদের সেবার জন্য “হাসি” নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। ঐ প্রতিষ্ঠানটি এ বছর জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনিত হয়েছে। পারিবারিক জীবনে ও তিনি একজন সফল পিতা। তার ছেলে আবরার আহমেদ চৌধুরী শাকিল একজন আইনজীবী, কন্যা শাহিরা সারওয়াত চৌধুরী ডায়না একজন চিকিৎসক। স্ত্রী শওকত আরা চৌধুরী ছিলেন হবিগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজের অধ্যাপিকা। আজকাল রাজনীতিতে পেশী শক্তি, সন্ত্রাস, লুটপাট, অন্যায়, গ্রুপিং-লবিং, গুন্ডা-হুন্ডা, নিজস্ব বাহিনী ব্যবহার প্রধান নিয়ামক হিসেবে শুনা যায়। সেখানে শহীদ চৌধুরী ছাত্র নেতা থেকে জননেতা হতে এসবের ধারদারিতেও ছিলেন না, এখনও নেই। ফলে তিনি এখনও রয়ে গেছেন ‘বিখ্যাতদের আসনে’। ছাত্ররাজনীতির সতীর্থদের সহযোগিতা ও এলাকার জনগনের ভালবাসা ও সম্মানই তাকে বার বার সাফল্য এনে দিয়েছে। তৎকালীন মহকুমা শহরে অনেকেরই প্রাইভেট কার কিংবা বিলাস বহুল গাড়ী ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। সে সময় তিনি একটি জীপ গাড়ী নিয়ে চলাফেরা করতেন। নির্বাচনসহ সকল কাজে ব্যবহৃত হত ঐ জীপটি। আর এরই মধ্যে লুকিয়েছিল এক ধরনের আভিজাত্য। ১৯৪৯ সালে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার পিয়াইম গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে শহীদ উদ্দিন চৌধুরীর জন্ম। তাঁর পিতা আলাউদ্দিন চৌধুরী মাতা মরহুম সৈয়দা জমিলা। বাবা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার সিভিল সার্ভিসের সদস্য। তিনি তৎকালীন সময়ে সুনামের সাথে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বড় ভাই মরহুম অহিদ উদ্দিন চৌধুরী সওজ বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। অপর ভাই আশফাক উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন ঢাকা ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার ছোট ভাই জকি উদ্দিন চৌধুরী ও বড় বোন শাহেনা চৌধুরী আমেরিকা প্রবাসী। তার চাচাতো ভাই মরহুম মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ছিলেন। সফল জীবনের অধিকারী শহীদ উদ্দিন চৌধুরী সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভারত, লন্ডন, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়ামে সরকারিভাবে সফর করেছেন। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী শহীদ চৌধুরীর আদর্শ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবন গাথায় যোগ হয়েছে চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, রোটারী ইন্টারন্যাশনাল, নাটাব, ম্যানিলা ও বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিল এবং লন্ডন টাওয়ার হ্যামলের্টস এর মত প্রতিষ্টানের সম্মাননা। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদের সদস্য। আজ ১৯ নভেম্বর ২০২০ জন নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরীর ৭১ তম জন্ম দিন। জন্ম দিনে তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘাছু কামনা করছি। তিনি শতাছু নিয়ে জনগনের সেবায় নিয়োজিত থাকুন এ প্রত্যাশা করি।
রুহুল হাসান শরীফ, আইনজীবী ও সাংবাদিক, ১৯/১১/২০২০ইং।


     এই বিভাগের আরো খবর