,

নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে একমত বাংলাদেশ বৃটেন ॥ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ

সময় ডেস্ক ॥ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব, বিধিবহির্ভূত আটক, বিধিবহির্ভূত বিচারপ্রক্রিয়া এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ পুনর্ব্যক্ত করেছে বৃটেন। একই সঙ্গে উভয় দেশই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব, জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে সুশীল সমাজের উপস্থিতি ও মতপ্রকাশ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে একমত হয়েছে। ঢাকাস্থ বৃটিশ হাই কমিশন জানিয়েছে- বৃহস্পতিবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত চতুর্থ স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগে উপরুল্লিখিত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। শুক্রবার পাঠানো ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ওই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ইস্যু, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে কার্যকর মতবিনিময় হয়েছে বৃটেনের। বাংলাদেশ ও বৃটেন উভয়ে ২০১৯ সালের পর প্রথমবারের মতো সশরীরে সাক্ষাতের সুযোগকে স্বাগত জানিয়ে সংলাপ শুরু হয়। বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে অনুষ্ঠিত এবারের কৌশলগত সংলাপ বৃটেন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করেছে। উভয় দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রবাসী সংযোগ ও কমনওয়েলথের সদস্যপদের কারণে মানুষের সাথে মানুষের সুদৃঢ় সম্পর্কের উপর গুরুত্বারোপ করেন। বাংলায় পাঠানো বৃটিশ হাই কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মতে, বৃটিশ সরকারের ফরেন কমনওয়েলথ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসে (এফসিডিও) অনুষ্ঠিত চতুর্থ বারের মত বার্ষিক ওই কৌশলগত সংলাপে বৃটিশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন- দেশটির ফরেন কমনওয়েলথ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের পার্মানেন্ট আন্ডার সেক্রেটারি স্যার ফিলিপ বার্টন কেসিএমজি ওবিই ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সেক্রেটারি) অ্যাম্বাসেডর মাসুদ বিন মোমেন।বিজ্ঞপ্তি মতে, ফরেন কমনওয়েলথ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)’র দক্ষিণ এশিয়া ও কমনওয়েলথ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী উইম্বলডনের লর্ড তারেক আহমেদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব অ্যাম্বাসেডর মাসুদ বিন মোমেনকে স্বাগত জানান। লর্ড আহমদ বলেন: “আজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও আমি বৃটেন ও বাংলাদেশের মধ্যেকার দৃঢ় সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছি। আমরা উভয়েই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ভবিষ্যতে আমাদের দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যকে আরো শক্তিশালী করার সুযোগ নিয়ে আলোচনা করেছি।” বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়- বৃটেন ও বাংলাদেশে কোভিড-১৯ অতিমারী চলাকালীন যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এই সংলাপে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা। দেশব্যাপী কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি (বিশেষ করে কোভ্যাক্স থেকে প্রাপ্ত টিকার মাধ্যমে) পরিচালনার জন্য বৃটেন বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানায়। বৈঠকে এফসিডিও এর বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে উঠে আসা বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কিত কিছু বিষয় (যেমন: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব, বিধিবহির্ভূত আটক, বিধিবহির্ভূত বিচারপ্রক্রিয়া, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড) নিয়ে বৃটেন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে উল্লেখ করে বলা হয়, উভয় দেশই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব, জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে সুশীল সমাজের উপস্থিতি ও মতপ্রকাশ ও ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে একমত হয়েছে। সংলাপে সংঘাত প্রতিরোধ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা সমর্থন সহ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একে অপরকে সহযোগিতা করতে বৃটেন ও বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে উভয় দেশই প্রশিক্ষণ, পেশাগত সামরিক শিক্ষা ও ইন্সট্রাকশনাল এক্সচেঞ্জ সহ যৌথ সহযোগিতাকে স্বাগত জানায় এবং এই বছরের শেষের দিকে একটি প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংলাপ উদ্বোধনের আশা ব্যক্ত করেন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায়, বৃটেন ও বাংলাদেশ বিশ্বের সকল দেশকে আরো দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বৃটেন। আগামী বছরগুলোতে কার্বন নির্গমন হ্রাস ও ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নির্গমন সহ, একটি নিট জিরো টার্গেট ও কয়লা শক্তির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা জন্য বাংলাদেশের নেতৃত্বকে আরও উৎসাহিত করে। বিভিন্ন উৎস থেকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে বৃটেনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে উদ্বোধন হওয়া ইউকে-বাংলাদেশ ক্লাইমেট পার্টনারশীপের জন্য উভয় দেশই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য জাতিসংঘের সুপারিশ লাভ করায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে বৃটেন। এই উত্তরণকে সফল করতে সাহায্য করতে ও বাংলাদেশ যেন তাঁদের রপ্তানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে পারে, তাই বৃটেন ২০২৯ পর্যন্ত তাঁদের দেশের বাজারে বাংলাদেশের জন্য শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করলে উভয় দেশ তাঁদের উন্নয়ন অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ রূপ নিয়ে আলোচনায় বসবেন বলে সম্মত হয়েছেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগকারী হিসেবে বৃটেন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউকে-বাংলাদেশ ট্র্যাড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট ডায়লগের উদ্বোধনকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতির গুরুত্ব এবং বাজার প্রবেশাধিকার বাধা হ্রাস করার উপর বৃটেন জোর দিয়েছে। এতে করে উভয় দেশ লাভবান হবে। উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অভিবাসন ও সম্পর্কের গভীরতাকে বৃটেন ও বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। চলাচল ও অভিবাসন বিষয়ক একটি পার্টনারশীপ গঠনে যুক্ত হতে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। বৃটেন তাদের নতুন পয়েন্টভিত্তিক অভিবাসন ব্যবস্থায় প্রদত্ত সুযোগগুলির কথা উল্লেখ করে। দুই দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করতে বৃটেন বাংলাদেশকে ‘ক্রস বর্ডার উচ্চশিক্ষা আইন’ বাস্তবায়নের অনুরোধ জানায়। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানের জন্যে বৃটেন বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সাথে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্য নিয়ে বৃটেন ও বাংলাদেশ নিজ নিজ প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। রোহিঙ্গাদের কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয় বৃটেন এবং উল্লেখ করে যে, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত করবে ও বাংলাদেশে থাকাকালীন মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে সাহায্য করবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে উভয় দেশ আসিয়ান ও জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে উভয় দেশ দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের উপায় নিয়ে আলোচনা করে। বৃটেন কারিগরি সহায়তা প্রদান ও প্রোগ্রামের মাধ্যমে কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রভাব উন্নত, জনস্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোকে আরো মজবুত এবং জলবায়ু পরিবর্তন সঙ্কট মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে তা তুলে ধরে। পরিশেষে, উভয় দেশ এই সংলাপের মাধ্যমে গঠনমূলক আলোচনাকে স্বাগত জানায়। পরবর্তী কৌশলগত সংলাপ (পঞ্চম) ২০২২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার আশা ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে চতুর্থ সংলাপ শেষ হয়।


     এই বিভাগের আরো খবর