,

ভয়ঙ্কর ভিংরাজ বিবি

সময় ডেস্ক ॥ ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গি। ষাট বছরের এই বৃদ্ধা নিজের অসহায়ত্বের কথা বলে মানুষের সহানুভূতি আদায় করেন। এরপর গৃহপরিচারিকা হিসেবে আশ্রয় নেন বাড়িতে। কিছুদিন পর সুযোগ বুঝে হয়ে ওঠেন ভয়ঙ্কর। চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে এক গৃহকর্ত্রীকে হত্যা ও মালামাল লুটের মামলায় গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে গৃহপরিচারিকার আড়ালে তার ‘লোমহর্ষক সব’ লুটের ঘটনা। বেঙ্গাই বানু আশ্রয় নেওয়া বাড়িতে সুকৌশলে পরিবারের সদস্যদের চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করতেন। এরপর বাড়ি থেকে নগদ অর্থ, সোনার গয়নাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে পালিয়ে যেতেন। নিজের ছেলেকে নিয়েই অনেক বছর ধরে চালাচ্ছিলেন এমন অপকর্ম। তার এমন কাজে প্রাণও গেছে এক নারীর। গত বুধবার রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার মাহমুদপুর এলাকায় থেকে ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গি (৬০) ও তার ছেলে জয়নাল হোসেনকে (৩৫) গ্রেপ্তার করেছে মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানা পুলিশ। পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে বড়লেখা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের হাকিম হরিদাস কুমারের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গি। পরে আদালত তাকে ও তার ছেলেকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গি হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার মৃত আব্দুল হামিদের স্ত্রী ও তার ছেলে জয়নাল হোসেন। পুলিশ জানায়, ভিংরাজ বিবি তার নিজ এলাকায় (গ্রামের বাড়িতে) স্বর্ণ বেঙ্গি নামে পরিচিত। চুরিই তার নেশা এবং পেশা। ছদ্মবেশে ঠিকানা গোপন করে সে বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িতে কাজ নেয়। পরে সুযোগ বুঝে বাসায় থাকা স্বর্ণালংকার এবং নগদ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তার নামে লাখাই থানায় একটি এবং তার ছেলে জয়নাল হোসেনের নামে বাহুবল থানায় একটি ডাকাতি মামলা রয়েছে। থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের গত ১৪ জানুয়ারি ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গি বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের বড়থল গ্রামের বৃদ্ধা হাজেরা বেগমের বাড়িতে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ চান। ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু স্বামী-সন্তান কেউ নেই বলায় হাজেরা বেগম ও তার ছেলে সেলিম আহমদের দয়া হয়। মানবিক কারণে তাই তারা ওই নারীকে ঘরের কাজের জন্য রেখে দেন। বৃদ্ধা হাজেরা বেগম দেশে বসবাস করলেও তার ১ ছেলে ও ৩ মেয়ে আমেরিকায় থাকেন। অপর ছেলে সেলিম আহমদ স্ত্রী-সন্তানসহ বড়থল গ্রামে বসতবাড়িতে থাকেন। তার সঙ্গে বৃদ্ধা হাজেরা বেগমও বসবাস করেন। গত ২২ জানুয়ারি দুপুরে হাজেরা বেগমের ছেলে সেলিম আহমদ বৃদ্ধা মা ও গৃহপরিচারিকা ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গিকে বাড়িতে রেখে স্ত্রী-সন্তানকে ডাক্তার দেখাতে বড়লেখায় যান। সন্ধ্যার পর তিনি বাড়ি ফিরে মাকে অজ্ঞান অবস্থায় খাটের ওপর পড়ে থাকতে দেখেন। এসময় গৃহপরিচারিকা ভিংরাজ বিবিকে তিরি খুঁজে না পাননি। পরে দেখেন ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো এবং তার মায়ের পরণে থাকা এবং ঘরের বিভিন্ন আলমারীতে থাকা প্রায় ৯ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকাসহ প্রায় ৮ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে ওই গৃহপরিচারিকা পালিয়ে গেছেন। এদিকে অচেতন অবস্থায় গৃহকর্ত্রী হাজেরা বেগমকে উদ্ধার করে সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে আবার সিলেটে মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় হাজেরা বেগমের ছেলে সেলিম আহমদ বাদী হয়ে বড়লেখা থানায় মামলা করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযানে নামে পুলিশ। প্রযুক্তির সহায়তায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বড়লেখা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুব্রত কুমার দাস আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করেন। এরপর উপপরিদর্শক (এসআই) সুব্রত কুমার দাসের নেতৃত্বে উপপরিদর্শক (এসআই) জাহেদসহ একদল পুলিশ গত বুধবার রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার মাহমুদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গি ও তার ছেলে জয়নাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করেন। পুলিশ জানায়, ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গি অসহায়ত্বের কথা বলে সুজানগরের ওই বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়ির লোকজনকে সে ভুল ঠিকানা দেয়। এরপর চুর বেঙ্গি তার ব্যবহার দিয়ে বাড়ির সবাইকে প্রলুব্ধ করে ফেলে এবং বিশ্বস্থতা অর্জন করে।’ শুধু এ ঘটনাই নয় এর আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে উপজেলার দাসেরবাজার ইউনিয়নের সুড়িকান্দি এলাকায় এক বাড়িতে অসহায়ত্বের কথা বলে ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গি কাজ নেন। এরপর সপ্তাহখানেক পরে ওই বাড়ির এক নারীকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে প্রায় ২ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বাড়ির এক আত্মীয় বলেন, ‘ওই নারী প্রথমে তার বাড়ি সুজানগর ইউনিয়নে বলে পরিচয় দেয়। এরপর তার অসহায়ত্ব দেখে তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ পর অজ্ঞান করে মালামাল লুটে নিয়ে যায়। সুজানগর এলাকার ঘটনার পর আমরা বুঝতে পারি এই মহিলা ভয়ঙ্কর চুর।’ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বড়লেখা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুব্রত কুমার দাস শুক্রবার (১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বলেন, ‘ভিংরাজ বিবি ওরফে বেঙ্গাই বানু বেঙ্গি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। স্বীকারোক্তিতে ঘটনার বর্ণনা করেছেন। আদালতকে তিনি জানিয়েছেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে গৃহকর্ত্রী হাজেরা বেগমকে তারা অজ্ঞান করে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা নিয়ে পালিয়ে যান।’ তিনি আরও বলেন, ‘সে ভুল ঠিকানা দিয়ে ওই বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এরপর তাকে চিহ্নিত করে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু কৌশলী ভিংরাজ বারবার স্থান পরিবর্তন করে। একাধিক অভিযান পরিচালনার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।’


     এই বিভাগের আরো খবর