,

‘তথ্য নেই’ নবীগঞ্জ উপজেলা তথ্য বাতায়নে :: দায়সারাভাবে চলছে সরকারি ওয়েবসাইট :: বিড়ম্বনায় জনসাধারণ

নিয়মিত অফিস করেন না সহকারী প্রোগ্রামার মঈনুল

মোঃ সেলিম তালুকদার : ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সংকল্প নিয়ে একের পর এক ডিজিটাল কার্যক্রম শুরু করেছে বর্তমান সরকার। ইন্টারনেট সুবিধা গ্রামীণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ইউনিয়ন পর্যায়েও ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়েছে। সরকারের ডিজিটাল কার্যক্রমে অন্যতম একটি হলো ‘তথ্য বাতায়ন’। তথ্য জানার অধিকার সবার। জেলা-উপজেলার কোথায় কি আছে, কি সেবা কিভাবে পাওয়া যাবে? তথ্য নিয়ে স্থান-কাল-পাত্র জেনে সেবা গ্রহণ করলেই সঠিক সেবা পাওয়া সম্ভব।
(http://nabiganj.habiganj.gov.bd/bn) নবীগঞ্জ উপজেলার তথ্য বাতায়নে এই উপজেলার পরিচিতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ভৌগোলিক ও অর্থনীতিসহ অনেক অজানা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য রয়েছে। কিন্তু বেশীরভাগ তথ্যেরই অভাব রয়েছে এই পোর্টালটিতে। জাতীয় তথ্য বাতায়নের নবীগঞ্জের বিভিন্ন সরকারি দফতর-অধিদফতরের তথ্য আপডেট হচ্ছে না দীর্ঘ দিন ধরে। ফলে ডিজিটাল সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নবীগঞ্জ উপজেলার জনসাধারণ।
নবীগঞ্জ উপজেলা তথ্য বাতায়ন যে দায়সারাভাবে চলছে তা এই ওয়েবসাইটটি ভিজিট করলেই বোঝা যায়। চলতি বছরের ১১ অক্টোবর ওয়েবসাইটটি শেষ হালনাগাদ করা হলেও প্রয়োজনীয় সকল তথ্য মিলছে না এতে, এছাড়া ভূল তথ্যেরও হিসেব নেই ওয়েবসাইটটিতে। দায়সারাভাবে সরকারি এই ওয়েবসাইটটি পরিচালিত হওয়ায় তথ্য বিভ্রাটে পরিণত হয়েছে নবীগঞ্জ উপজেলা তথ্য বাতায়ন।
অভিযোগ রয়েছে- জাতীয় তথ্য বাতায়নে নবীগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ তথ্যই মিলছে না। দায়সারাভাবে চলছে ওয়েবসাইটটির হালনাগাদ কার্যক্রম, নিয়মিত অফিস না করার অভিযোগও রয়েছে উপজেলা সহকারী প্রোগ্রামার কাজী মঈনুল ইসলামের বিরদ্ধে। এছাড়া তিনি মাঝে মধ্যে অফিসে আসেন ১১ থেকে ১২টার পর, শুধু আসা যাওয়াই যেন উপজেলা সহকারী প্রোগ্রামারের দায়িত্ব।
তথ্যের মধ্যে মিলছে কেবল সরকারি বিভিন্ন দফতরের সেবাসমূহের। বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তাগণের পরিচিতিও মিলছে না এতে। ৩/৪ বছর আগে চলে যাওয়া কর্মকর্তার নাম/ছবি/নম্বর এখনো দেখাচ্ছে সেখানে। তথ্য বাতায়নে নবীগঞ্জের এই হাল সচেতন মহলে প্রশ্ন তুলেছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন- সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের উদাসীনতা আর অক্ষদতার জন্যই জাতীয় তথ্য বাতায়নের মতো সরকারের একটি ভাল উদ্যোগ কেবল নাম পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তথ্য বাতায়ন ঘেটে নবীগঞ্জের প্রয়োজনীয় তথ্য না পেয়ে অনেকেই শূন্য তথ্য দেখে বিস্মিত হয়েছেন।
নবীগঞ্জ উপজেলা তথ্য বাতায়নটি ঘুরে দেখা যায়- হোম পেইজে আমাদের সর্ম্পকে একটি ক্যাটাগরি রয়েছে এতে কর্মকর্তাগণ নামের একটি অপশন আছে। এতে ক্লিক করলে দেখা যায় শুধু বর্তমান ইউএনও ইমরান শাহরীয়ারের নাম ও প্রোফাইল দেখাচ্ছে। আর কোন কর্মকর্তার নাম/তথ্য কিছুই নেই।
উপজেলা পরিষদ ক্যাটাগরিতে চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেকদের তথ্য এবং কর্মকর্তাবৃন্দের তথ্যের মিল থাকলেও উপজেলা পরিষদের কার্যাবলি ও সাংগঠনিক কাঠামোর কোন তথ্য নেই এতে।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ভূমি অফিসের সেবা সম্পর্কিত তথ্য থাকলেও সহকারী কমিশনার পদে কত কর্মকর্তার যোগদান হলো, বদলি হলো। কিন্তু দূঃখজনক হলেও এতে নেই কোন কর্মকর্তারই তথ্য। বর্তমান কিংবা সাবেক কোন সহকারী কমিশনারের নাম/মোবাইল নম্বর কিছুই নেই। এসব দেখারও যেন কেউই নেই।
পত্র-পত্রিকায় তালিকায় রয়েছে ৭টি পত্রিকার নাম। এগুলোর মধ্যে ৬টি পত্রিকাই নবীগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয়না। ১টি দীর্ঘদীন ধরে বন্ধ থাকলেও যেটি নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে সেটিরও নাম নেই।
ডাক্তারের তালিকায় দেখা যায় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তার লেখা আছে ডাঃ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম‘র নাম। কিন্তু তিনি বদলি হয়েছেন আরো প্রায় ৩ বছর আগেই। বর্তমানে দায়িত্বে রয়েছেন তৎকালীন আবাসিক মেডিকেল অফিসার বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ আব্দুস সামাদ। দেখা যায় তথ্য বাতায়নে ডাঃ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম‘র নামই রয়েছে। এছাড়া একাধিক ডাক্তারগণ বদলী হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন কিন্তু তালিকায় পুরাতনদের নাম বিদ্যামান রয়েছে।
সরকারী অফিসসমূহের অপশনে গিয়ে থানার প্রোফাইলে কেবল ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ ডালিম আহমদের প্রোফাইল এবং কর্মচারীবৃন্দের তালিকায় কেবল রাজু আহমদ নামে এক কনস্টেবলের তথ্য দেখা যায়। এছাড়া থানার আর কোন অফিসার/কর্মচারীর তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়াও থানার তথ্য প্রদানকারী কোন কর্মকর্তার তথ্যও পাওয়া যায়নি এতে।
উপজেলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিসের সেবাসমূহ এবং মাত্র ২/৩ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীর তথ্য পাওয়া যায়। উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিস প্রোফাইলেরও একই দশা। উপজেলা রির্সোস সেন্টার অপশনে ইন্সট্রাক্টর পদে মোহাম্মদ জাকির হোসেন নামে এক কর্মকর্তার প্রোফাইল থাকলেও এতে কি কি সেবা পাওয়া যায়, বা কীভাবে কি সেবা পাওয়া যায়, কীভাবে এতে যোগাযোগ করতে হবে কিছুই দেয়া নেই। উপজেলা মৎস্য অফিসের ক্যাটাগরিতে কেবল কর্মকর্তাবৃন্দের প্রোফাইল থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় সকল তথ্য। উপজেলা খাদ্য অফিসের ক্যাটাগরি থাকলেও প্রয়োজনীয় বেশীরভাগ তথ্যই নেই এতে। নামমাত্র ’উপজেলা আইসিটি ট্রেনিং এন্ড রিসোর্স ফর এডুকেশন’ অপশনটি থাকলেও কোন তথ্যই নেই এতে। এছাড়া উপজেলা শিক্ষা অফিস, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস, উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার, নবীগঞ্জ হাসপাতাল, প্রাণীসম্পদ র্কাযালয়সহ অনেক অফিসেরই পরিপূর্ণ তথ্য নেই এই পোর্টালে।
জনপ্রতিনিধিদের অপশনে মাত্র বর্তমান/সাবেক ৩৩ জন জন প্রতিনিধির তথ্য পাওয়া যায়। অথচ উপজেলায় রয়েছেন প্রায় দেড় শতাধিক জনপ্রতিনিধি।
এছাড়া উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদসমূহ অপশনটি ভিজিট করে ২নং বড় ভাকৈর (পূর্ব) ইউনিয়ন পরিষদের মাত্র ৪ জন জনপ্রতিনিধির তথ্য, ১০নং দেবপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ মাত্র ৪ জন জনপ্রতিনিধির তথ্য এবং ৪নং দীঘলবাক ইউনিয়ন পরিষদ এবং ১১নং গজনাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের কোন জনপ্রতিনিধির তথ্যই পাওয়া যায়নি।
এ নিয়ে নবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী নূরী আক্তার (ছদ্মনাম) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা অনেক তথ্য জানিনা। তথ্য জানতে প্রয়োজনের সময় তথ্য বাতায়ন থেকে যে তথ্যটি পাচ্ছি তা যদি ভুল হয়, তাহলে নামকাওয়াস্তে তথ্য বাতায়ন থেকেই বা লাভ কি? অনেক তথ্য মিলেনা এই তথ্য বাতায়নে আর যা ই আছে এর মধ্যে অনেক তথ্যই ভূল রয়েছে। এ সময় নিয়মিত আপডেটের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।’
তথ্য বাতায়নের ভূল তথ্য নিয়ে বিড়ম্বনায় রয়েছেন প্রবাসীরাও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন নবীগঞ্জ উপজেলার অনেক রেমিট্যান্স যোদ্ধা। তারা সহজে নবীগঞ্জের সকল তথ্য জানতে প্রবেস করেন তথ্য বাতায়নে। কিন্তু গিয়ে দেখেন তথ্য বাতায়নেই নেই তথ্য।
এ প্রসঙ্গে গ্রিস প্রবাসী সাংবাদিক মতিউর রহমান মুন্না বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন নবীগঞ্জ থেকে সাংবাদিকতা করেছি। প্রবাসে থাকলেও আমার মনটা পড়ে রয়েছে নবীগঞ্জে। নবীগঞ্জের বিভিন্ন তথ্য জানতে যখন তথ্য বাতায়নে প্রবেশ করি তখন রিতিমত হতাশ হই। সব দপ্তরে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, সব দপ্তরে ডিজিটাল সেবা নিশ্চিতে রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ। সবই চলছে সরকারি খরচে। নেই কেবল তথ্য বাতায়নে হালনাগাদ তথ্য। এখানে তথ্য আপডেট করতে তো কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কোন খরচ হচ্ছে না, সবই সরকার দিচ্ছে তবুও কেন তারা উদাসহীন? সকল পুরনো তথ্যই রয়েছে তথ্য বাতায়নে, ভুলে ভরা সরকারি ডিজিটাল সেবার এ তথ্য বাতায়ন। আর এসব ভুল তথ্যে বিভ্রান্তিতে পড়েছি আমরা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের আওতায় পরিচালিত হয় জাতীয় তথ্য বাতায়ন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে সারা দেশের জেলা, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের সরকারি দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সমন্বয়ে জাতীয় তথ্য বাতায়নের আওতায় আলাদা আলাদা ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা হয়েছে। জনগণের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণ ও সরকারি দপ্তর থেকে প্রদেয় সেবাসমূহ প্রাপ্তির নিশ্চয়তার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় তথ্য বাতায়ন। কিন্তু সরকারের কর্মকর্তাদের উদাসীহীনতায় সাধারণ নাগরিকেরা ঘরে বসেই নিজ নিজ এলাকার প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা অনলাইনে পাচ্ছে না, এমনকি এ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলার সুযোগ পাচ্ছেন।’ এ বিষয়ে নজর দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন প্রবাসী সাংবাদিক মতিউর রহমান মুন্না।
প্রসঙ্গত প্রশ্ন উঠেছে তথ্য বাতায়নের তদরকির দায়ীত্ব কার? কেউই কি সংশ্লিষ্টদের হালনাগাদের জন তাগিদ দেননা? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়- এই দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা সহকারী প্রোগ্রামার কাজী মঈনুল ইসলাম। দায়িত্বে থাকলেও নিয়মিত অফিস না করা ও দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালনের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। জাতীয় তথ্য বাতায়নে তথ্য আপডেট নেই কেন? এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কাজী মঈনুল ইসলাম বলেন ‘স্ব স্ব দপ্তর থেকে আমাকে যে তথ্যগুলো দেয়া হয় সেগুলো আমি আপডেট করি। তাছাড়া প্রত্যেকটা দপ্তরেরই আলাদা লোক রয়েছে তারা আপডেট করে থাকে, তারা যদি আপডেট করতে বা সাইটে কোন সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে আমি তাদেরকে সহযোগীতা করি। প্রত্যেকটা ইউনিয়ন পরিষদেই আপডেটের জন্য নির্বাচনের পরপর আমি তাগিদ দিয়েছি।’ নবীগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রকাশিত পত্র পত্রিকার তথ্য নেই কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী মঈনুল ইসলাম বলেন- ‘এগুলোর তথ্য আমাকে ইউএনও মহোদয় দেন নি, তাই আপডেট করতে পারি নি।’
এ বিষয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন- ‘এটা প্রত্যেকটা দপ্তরের দায়িত্ব, আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চিঠি দেব, শীঘ্রই এটা আপডেট করা হবে।


     এই বিভাগের আরো খবর