,

১ বছরেও পাসপোর্ট পাননি নবীগঞ্জের তিনজন :: গ্রিসে পাসপোর্ট জটিলতায় আটকে আছে বাংলাদেশিদের ভাগ্যের চাকা

মতিউর রহমান মুন্না, গ্রিস থেকে : হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা গ্রিস প্রবাসী আব্দুল কালাম চলতি বছরের মার্চ মাসের ২ তারিখ মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) এর জন্য আবেদন করেছিলেন। গ্রিসের এথেন্সে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস আব্দুল কালামের নতুন পাসপোর্টের আবেদনটি গ্রহণ করে পরের মাস অর্থাৎ এপ্রিলের ২৫ তারিখ পাসপোর্টটি সংগ্রহ করার জন্য একটি রসিদ দিয়েছিল। কিন্তু ৮ মাস অতিবাহিত হলেও এখনোও পাসপোর্টটি ছাপা হয়নি। দূতাবাসে গেলে কর্মকর্তারা অনলাইনে চেক করে বলছেন পুলিশ ভেরিফিকেশন এর জন্য আটকে আছে। অপরদিকে পুলিশ বলছে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনটি পাঠানো এপ্রিল মাসেই পাঠিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
প্রবাসী আব্দুল কালাম বলেন- ‘গ্রিসে বৈধ হওয়ার সুযোগ এসেছে। কিন্তু পাসপোর্ট না পেলে আমরা এ সুযোগটি হারাবো।’ আব্দুল কালাম বলেন ‘দূতাবাসে গেলে কর্মকর্তারা বলেন পাসপোর্ট ঢাকা অফিসে আটকে আছে। জেলা পুলিশে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন গত এপ্রিলেই তদন্ত করে পক্ষে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, আমাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা মোকদ্দমা নেই’, কিন্তু দূতাবাসের কমকর্তারা অনলাইনে দেখে বলছেন পুলিশ রিপোর্টের জন্য আটক আছে। তারা কিছু জানেন না’। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছেন এই প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধা। শুধু আব্দুল কালামই নয় গ্রিসে পাসপোর্ট জটিলতায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে অনেক বাংলাদেশির ভবিষ্যৎ। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ইউরোপে বৈধ হতে পাসপোর্টের ভূল তথ্যের কারণে পরছেন নানা বিড়ম্ভনায়। এমনকি অনেকেই অবৈধ পথে এনালগ পাসপোর্ট নিয়ে গ্রিসে প্রবেশ করেছেন কিন্তু তাদের কাছে বর্তমানে নেই কোন পাসপোর্ট। নতুন করে পাসপোর্ট করার সুযোগও পাচ্ছে না তারা। এমন সমস্যা প্রতিকারের আশায় দৌড়ঝাঁপ করে সদুত্তর না পেয়ে অনেকটা হতাশায় ভুগছেন।
গ্রিসে বর্তমানে ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি বসবাস করেন। কিন্তু এদের মধ্যে সিংহভাগই অনিয়মিত। নেই কোন বৈধ কাগজপত্র। এমনকি অনেক প্রবাসীই আছেন যাদের ইউরোপে বৈধতা তো দূরের কথা তাদের কাছে নেই নিজ দেশের পাসপোর্টও। কারণ ৮ থেকে ১০ বছর আগে বিভিন্ন অবৈধ পথে গ্রিসে প্রবেশ করেছেন এমন বহু বাংলাদেশি রয়েছেন।
এদিকে নানা জল্পনা কল্পনার পর বাংলাদেশ ও প্রাচীণ সভ্যতার দেশ গ্রিসের সমঝোতা চুক্তিটি গ্রিক সংসদে অনুমোদন হয়েছে। এর ফলে প্রতি বছরে ৪ হাজার করে কর্মী মৌসুমি কর্মভিসায় নেওয়ার পাশাপাশি গ্রিসে থাকা অবৈধ ১৫ হাজার অভিবাসীদেরকেও বৈধতা দেয়া হবে। অনিয়মিত বাংলাদেশীদের নিয়মিতকরন বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস এথেন্স কর্তৃক আরেকটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে- নিয়মিত হওয়ার জন্য ২ বছরের বেশী মেয়াদ সম্পন্ন পাসপোর্ট, দূতাবাস হতে পাসপোর্টের সত্যায়িত কপি লাগবে। কিন্তু যাদের পাসপোর্ট নেই তারা এখন মহা বিপদে পড়েছেন। এ নিয়ে অনেকেই হতশায় ভুগছেন।
এদেরই একজন গ্রিস প্রবাসী নবীগঞ্জের বাসিন্দা অজুদ মিয়া জানান, প্রায় ১০ বছর পূর্বে ইরান-তুরস্ক হয়ে গ্রিসে প্রবেশ করেন। তখন বাংলাদেশে এনালগ পাসর্পোটের যুগ ছিল। সেই হাতের লেখা পাসপোর্ট নিয়েই গ্রিসে বিদেশে পাড়ি জমান। তিনি গ্রিসে প্রবেশের সময় দালালের নির্দেশে সীমান্তে এনালগ পাসপোর্টটিও ফেলে দেন। শূন্য অবস্থায় প্রবেশ করেন গ্রিসে। দেশ থেকে ধার দেনা করে গিয়েছেন বিদেশে। সেগুলো পরিশোধ করার চাপও আছে। তাই তিনি গ্রিসে গিয়েই চলে যান কৃষি কাজে নেয়া মানলোদা নামক স্থানে। সেখানে কৃষি কাজ করে কিছু টাকা নিজের খরছের জন্য রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেন দেশে। এভাবেই অবৈধ অবস্থায় কেটে যায় কয়েক বছর। এরপর অজুদ মিয়া সেখানে বসবাসের অনুমতি নিতে চান। বৈধভাবে বসবাস করতে চান। কিন্তু তার পাসপোর্ট নেই। দূতাবাসে গেলে কর্মকর্তারা জানান- বাংলাদেশ থেকে নতুন পাসপোর্ট আবেদন গ্রহণের নির্দেশনা আসলে আবেদন নেয়া হবে। অবশেষে ২০২১ সালে আসে নতুন করে পাসপোর্ট তৈরী করার সুযোগ। তিনিও বার বার চেষ্টা করে দূতাবাসে গিয়ে নির্ধারিত ফি ও সকল দলিলসহ আবেদন করেন। এরপর অপেক্ষার পালা। মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে কিন্তু পাসপোর্ট মিলছে না। দূতাবাসে গেলে কর্মকর্তারা জানান পাসপোর্ট ঢাকায় আটক আছে তাদের কিছু করার নেই। বর্তমানে বৈধ হবার সুযোগ তৈরী হয়েছে কিন্তু পাসপোর্ট না পেলে এ সুযোগ হারানোর আশঙ্কায় আছেন অজুদ মিয়া। তিনি জানান তার মতো প্রায় অসংখ্য মানুষ পাসপোর্ট নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন।
তাদেরই আরেকজন মোহাম্মদ পাভেল। তিনি জানান, ‘দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর গত বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনি দূতাবাসে গিয়ে আবেদন জমা করে আঙ্গুলের চাপ দিয়ে আসেন। তখন তাকে বলা হয়েছিল ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন। কিন্তু একে একে প্রায় ৯ মাস কেটে গেল কিন্তু পাসপোর্টের কোন হদিস নেই। পাসপোর্টের কারনে তিনি বৈধ হতেও পারছেন না।’ পাভেল আরো বলেন- ‘আমরা চাই বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে, দেশকে আরো শক্তিশালী করতে কিন্তু পাসপোর্ট না থাকায় তা করতে পারছি না। বাংলাদেশ পাসপোর্ট অধিদপ্তর আমাদের এ সুযোগ দিচ্ছে না। তারা আমাদের কাছ থেকে প্রায় ১০০ ইউরো ফি সহকারে আবেদন গ্রহণ করে কেন পাসপোর্ট আটকে রেখেছে। তারা কি চায় না আমরা বৈধ হই, আমরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করি।’
জড়িপে দেখা গেছে, নতুন পাসপোর্টের আবেদন ছাড়াও পাসপোর্টে নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম, বয়স, ঠিকানাসহ বিভিন্ন তথ্য সংশোধন ও পরিবর্তন ও কেউ কেউ চান আংশিক পরিবর্তন করতে চান। তবে অনেকেই তথ্যাদি আমূল বদলে ফেলতে চান। যেমন ১ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বয়স পরিবর্তনের আবেদনও করছেন দূতাবাসে। এর কারণ জাতীয় পরিচয়পত্রের তোয়াক্কা না করে কয়েক বছর আগে দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকে। যাদের অনেকের এনআইডিতে উল্লেখিত স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানার সঙ্গে পাসপোর্টে উল্লেখিত ঠিকানার মিল নেই। দালালরা চুক্তিতে এসব পাসপোর্ট তৈরী করে দেয়ার পর যারা এনিয়ে বিদেশে গেছেন তারা পড়েছেন বিপাকে। ওইসব পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় নবায়নের আবেদন করলে এনআইডির সঙ্গে তথ্যে গড়মিল থাকায় নতুন পাসপোর্ট হচ্ছে না। এমন নানা সমস্যার বেড়াজালে আটকে আছে অনেক প্রবাসীর ভাগ্যের চাকা।
অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলেন, গ্রিসে পাসপোর্ট জটিলতায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে অনেক প্রবাসীর ভবিষ্যৎ। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ইউরোপে বৈধ হতে পাসপোর্টের ভূল তথ্যের কারণে পড়ছেন নানা বিড়ম্ভনায়। এমনকি অনেকেই অবৈধ পথে এনালগ পাসপোর্ট নিয়ে গ্রিসে এসেছেন কিন্তু তাদের কাছে বর্তমানে নেই কোন পাসপোর্ট। নতুন করে পাসপোর্ট করার সুযোগও পাচ্ছে না তারা। বর্তমানে এমআরপি পাসপোর্ট নতুন করে করার কার্যক্রম গ্রিসে বন্ধ রয়েছে। এমনকি যারা ইতিপূর্বে আবেদন করেছে তাদের পাসপোর্টও আটকে আছে ঢাকায়। এমন সমস্যা প্রতিকারের আশায় দৌড়ঝাঁপ করে সদুত্তর না পেয়ে অনেকটা হতাশায় ভূগছেন বাংলাদেশিরা। অনেকেই বিভিন্ন সংশোধনের জন্য আবেদন করেছিলেন কিন্তু আবেদন গ্রহণ করা হলেও পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে না তাদের। এ কারণে অনেক বাংলাদেশি অবৈধ হচ্ছেন ইউরোপের এই দেশে। এমন নানা সমস্যার বেড়াজালে আটকে আছে অনেক প্রবাসীর ভাগ্যের চাকা। এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ও গ্রিসের মধ্যে একটি সমঝোতার ফলের গ্রিসে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বৈধ হবার সুযোগ তৈরী হয়েছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি শর্তের মধ্যে প্রথম শর্ত হচ্ছে নিজের পাসপোর্ট মূল কপি থাকতে হবে এবং এর ২ বছর মেয়াদ থাকতে হবে। কিন্তু যারা ৬ থেকে ১ বছর ধরে দৌড়ঝাঁপ করেও পাসপোর্ট পাচ্ছে না, তাদের কি হবে? তারা কিভাবে পাবে এই বৈধতার সুযোগ? বাংলাদেশ দূতাবাসকে এ ব্যাপারে প্রদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানান প্রবাসীরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রিসের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, ‘বাংলাদেশ ও গ্রিসের মধ্যে সমঝোতা চুক্তির ফলে অনিয়মিতদের বৈধ করণের সুযোগ আসছে। এ বছরই কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। বৈধতা পেলে অনেকেই উপকৃত হবেন। তবে বাংলাদেশিদের বৈধ হতে প্রথম শর্ত হচ্ছে মূল পাসপোর্ট লাগবে। বর্তমানে অনেকের কাছেই পাসপোর্ট নেই। এক্ষেত্রে অনিয়মিত প্রবাসীদের পাসর্পোটসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সমস্যা নিরসনের দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা ও প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।’
এ ব্যাপারে গ্রিসে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদ বলেন, ‘ঢাকায় যাদের পাসপোর্ট আটকে আছে দ্রুত তাদের পাসপোর্ট তৈরী হয়ে গেলে সবাই বৈধতার আওতায় আসতে পারবে। এই মর্মে পাসপোর্ট অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। গ্রিস প্রবাসী বাংলাদেশিদের যাদের পাসপোর্টে বিভিন্ন সমস্যা সংশোধনের আবেদন করা হয়েছে শুধু তাদের এই আবেদনগুলো দেখার জন্য পাসপোর্ট অধিদপ্তরে যাতে একজন কর্মকর্তা নিযুক্ত করে দায়ীত্ব দেয়া হয় সেই প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে গ্রিস দূতাবাস থেকে।’


     এই বিভাগের আরো খবর