,

‘ক্রাইম প্যাট্রল’ রপ্ত করে বাড়ছে খুনখারাবি

সময় ডেস্ক : পাঁচ বছরের শিশু আলীনা ইসলাম আয়াতকে গেল ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায় আবীর আলী। মুক্তিপণের জন্য তার বাবাকে দেওয়া হয় ফোন। একপর্যায়ে আয়াতকে শ্বাসরোধে হত্যা। লাশ গুম করতে আয়াতের তুলতুলে দেহখানা টুকরা টুকরা করে আবীর আলী। এরপর দুই প্যাকেটে ভরা হয় খণ্ড খণ্ড দেহ। এক প্যাকেট ছোড়া হয় সাগরবুকে, আরেকটি খালে। এমন নিষ্ঠুর হত্যার পর পার পায়নি ঘাতক আবীর। ধরা পড়ে পুলিশের জালে। তবে হত্যার পর কেন লাশের সঙ্গে এমন নিমর্মতা? পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আবীর বলেছে সে কথা। পুলিশকে আবীর জানিয়েছে- ভারতীয় টিভি শো ‘ক্রাইম প্যাট্রল’ দেখে দেখে হত্যার কৌশল আর আলামত লুকানোর পাঠ নিয়েছে সে।
২০২০ সালের অক্টোবরের আরেক ঘটনা। সাতক্ষীরার কলারোয়ার হেলাতলা ইউনিয়নের খলসি গ্রামে একই পরিবারের চারজনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ফোর মার্ডার মামলায় সিআইডির তদন্তে উঠে আসে কোমল পানীয়র সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ভাই-ভাবি ও ভাতিজা-ভাতিজিকে খাওয়ায় রাহানুর। পরে ঘুমন্ত চারজনকে চাপাতি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। রাহানুরও নিয়মিত ‘ক্রাইম প্যাট্রল’ দেখত। এই টিভি সিরিয়াল দেখেই খুনের কৌশল শেখে সে।
শুধু চট্টগ্রামের আয়াত কিংবা সাতক্ষীরার ফোর মার্ডারের ঘটনা নয়; বিভিন্ন সময় আরও বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের পর পুলিশ দাবি করেছিল, হত্যার পরিকল্পনা ও আলামত গোপন রাখার কলাকৌশল জড়িতরা ‘ক্রাইম প্যাট্রল’ ও ‘সিআইডি’ নামে ভারতীয় টিভি শো দেখে শিখেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধবিষয়ক এসব অনুষ্ঠানে খুন, অপহরণ, ধর্ষণের মতো ঘটনাকে অভিনয়ের মাধ্যমে বিস্তারিত তুলে ধরা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত কী ধরনের কৌশল নিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়া যাবে, তাও থাকছে। কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের আইনি বেড়াজালে নিয়ে আসে, সেটাও দেখানো হয়। সমাজে ঘটা বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিল রেখেই নানামুখী বিরোধ থেকে রক্তারক্তি, দাঙ্গা-হাঙ্গামার ছবি উপস্থাপক তুলে ধরেন। ক্রাইম প্যাট্রলে অপরাধ প্রতিরোধে বার্তা দেওয়ার বদলে অপরাধ সংঘটনের বিশদ বিবরণ দেওয়া হচ্ছে। এতে শিশু-কিশোর ও তরুণদের কারও কারও মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অপরাধবিষয়ক অনুষ্ঠান বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও ক্রাইম প্যাট্রল ও সিআইডি অনেকে নিয়মিত দেখেন। এসব অনুষ্ঠানে অপরাধকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, এতে অনেক সময় এমন বার্তা যায়- এসব স্বাভাবিক, এসব নিত্যদিনের ঘটনা। এ ছাড়া অনেক ভিডিও গেমেও শত্রুকে হত্যা করার কৌশল শেখার মধ্য দিয়ে শিশুদের এক ধরনের কল্পনার জগৎ গঠিত হয়। অনেকে বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বে শিশুরা টেলিভিশন বা ইন্টারনেটে সব অনুষ্ঠান দেখতে পারে না। সেখানে টেলিভিশন বা ইন্টারনেটে ‘প্যারেন্টাল লক’ নামে এক ধরনের ব্যবস্থা থাকে। আমাদের দেশে অধিকাংশ সময় মা-বাবা শিশু আর কিশোরদের নিয়ে অপরাধ-সহিংসতামূলক অনুষ্ঠান দেখছেন। এই ধরনের অনুষ্ঠানের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সন্তানকে কোনো বার্তা দিচ্ছেন না অভিভাবকরা। অনেক পরিবারে এসব অনুষ্ঠান দেখার ‘রিমোট কন্ট্রোল’ শিশু-কিশোরদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রধান জোবেদা খাতুন বলেন, শিশু-কিশোর আর পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের মনোজগতের গঠন স্বাভাবিক কারণে ভিন্ন হয়ে থাকে। কিশোর বয়সে ভালো আর খারাপের ব্যবধান করার ক্ষমতা থাকে না। ক্রাইম প্যাট্রলের মতো অনুষ্ঠানে অন্যকে বিপদে ফেলতে কী কী কূটকৌশল নেওয়া যেতে পারে- তার বিস্তারিত দেখানো হয়। কিশোর-তরুণদের কেউ কেউ তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যে হিরোইজম নিয়ে বাঁচতে চায়। তার মধ্যে এমন বোধও তৈরি হয়, ‘আমি ভালো আছি’- এর অর্থ, সবাই ভালো আছে। ‘আমি ভালো নেই’- এর অর্থ, অন্য কেউ ভালো থাকতে পারে না। আলো-আঁধারের পার্থক্য তাদের বোঝার বয়স হয়নি। তখন কোনো কোনো অনুষ্ঠানের চরিত্রকে তারা নিজেদের রূপে চিত্রায়িত করতে চায়।
জোবেদা খাতুন আরও বলেন, শিশু-কিশোরদের মনোজগতের সুচারু গঠনের জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখানো উচিত। পরিবারে মা-বাবাকে একই সুরে তার বাচ্চার সঙ্গে কথা বলতে হবে। একই বিষয়ে বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে আলাদা উপদেশ পেলেও শিশু-কিশোররা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে। শৈশব থেকে নৈতিকতা শেখানোর দিকে নজর দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ক্রাইম প্যাট্রলের মতো অনুষ্ঠানের সেন্সরশিপ দরকার কিনা, এটা ভাবার সময় এসেছে। এ ধরনের অনুষ্ঠানের শিক্ষণীয় অংশ রেখে প্রচার করা যেতে পারে। দুর্ভাগ্য হলো, কোনো ধরনের সেন্সরশিপ ছাড়াই এসব প্রচার হচ্ছে। এমন অনেক ছবি আছে, যা দেখে কিশোর-তরুণরা গ্যাং কালচারে উদ্বুদ্ধ হয়। সমাজ বদলের সঙ্গে সামনে অনেক চ্যালেঞ্জও আসে। এসব মোকাবিলা করেই সভ্যতার বিকাশ হয়েছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল অবশ্য ক্রাইম প্যাট্রলের মতো অনুষ্ঠানের প্রভাবকে ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, যদি কোনো নেতিবাচক ঘটনা থাকে, সেখান থেকেও কেউ কেউ ইতিবাচক শিক্ষা নিতে পারে। এটা একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে। তবে কারও অবচেতন মনে অপরাধপ্রবণ বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে থাকলে এ ধরনের অনুষ্ঠান থেকে নেতিবাচক সত্তা জাগ্রত হতে পারে। নৈতিকতার বদলে ভোগবাদী চিন্তা তার মাথায় জেঁকে বসবে। অনেকে গোয়েন্দা ও কিশোর উপন্যাস পড়ে সমাজের নেতিবাচক চরিত্র থেকে কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হবে, সেটা শেখে। আবার দু-একজন খলনায়ক হতে চায়। রোমাঞ্চ ও উদ্দীপনার বৈশিষ্ট্য ইতিবাচকভাবে ধরা দিলেই মঙ্গল হয়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, যারা অপরাধ সংঘটিত করছে, বেশিরভাগ সময় তারা নিজেদের মতো একটি কৌশল আগেই নিয়ে রাখে। ক্রাইম প্যাট্রল দেখে হয়তো তারা বিবেচনা করছে, তার নেওয়া পরিকল্পনার সঙ্গে এটা খাপ খায় কিনা।


     এই বিভাগের আরো খবর